আলোচনা সভায় বদিউল আলম

নারীদের ১০০ আসন দিতে হবে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৪, ১০:২৭ এএম

ঢাকা : জাতীয় সংসদে সাড়ে তিনশ আসনের মধ্যে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রক্রিয়া তাদের জন্য অপমানজনক বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার।

তিনি বলেছেন, নারীদের আসন দিতে হবে ১০০টি। তবে তা হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক (সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত)। কেননা এখন টাকা দিয়ে নারীদের আসন কিনে নেওয়া হচ্ছে।

শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীতে দুটি আলাদা আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন অন্তর্বতী সরকার গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিশনের এই প্রধান। প্রথমে আইন, আদালত ও মানবাধিকার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) আয়োজিত ‘কেমন সংবিধান চাই’ শীর্ষক আলোচনাসভায় নিজের মতামত জানান বদিউল আলম মজুমদার। এরপর নির্বাচন কমিশন বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যন্ড ডেমোক্রসির (আরএফইডি) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও একই ধরনের মন্তব্য করেন তিনি।

[237379]

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীকে ক্ষমতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪০০ আসন হলে ১০০টি নারীর জন্য বরাদ্দ করতে হবে, তাও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে। তৃণমূল পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

সংবিধানকে নানান সংশোধনীর মাধ্যমে নষ্ট করা হয়েছে উল্লেখ করে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘বিশেষ করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এক তৃতীয়াংশ পরিবর্তন করে সংবিধান কলুষিত করা হয়েছে। বর্তমানে সংবিধানে বহু অসঙ্গতি রয়েছে, যা পরিবর্তন করতে হবে।’

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য শুধু ২২টি দল ও জোটের কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তাদের শরীক এবং জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য নিবন্ধিত দলের কাছে মতামত চাওয়া হয়নি। এটা কি বৈষম্য হলো না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, ‘এটা নিয়ে আমরা আরেকদিন সংবাদ সম্মেলন করবো। আপনারা সরকারকে জিজ্ঞেস করেন। আমরা অনেকের কাছে মতামত নিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি সকল দল মতের ঊর্ধ্বে থেকে একটা সুপারিশ যেন করতে পারি।’

‘সরকারের সিদ্ধান্ত যদি আপনার কমিশনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা কেমন সংস্কার পাবো?’- এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার এই কমিশনগুলো গঠন করেছে। সরকার একটা কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমাদের করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। অবশ্যই সরকারের অভিপ্রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

[237386]

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘আমরা কোন প্রেক্ষাপটে এখানে এসেছি, প্রেক্ষাপট হলো-দেড় হাজারের মতো প্রাণহানি হয়েছে। ২০, ৩০ হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছে। তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। আমরা যেন তাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করি। আমরা তাদের রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য বদ্ধপরিকর। আমাদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই।’

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ গুরুতর অন্যায় বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় শুনি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সংবাদকর্মীসহ নির্বাচনে যুক্তদের নানাভাবে হয়রানি ও নজরদারি চালানো হয়। অতীতে এ ধরনের যেসব কর্মকাণ্ড হয়েছে, সেগুলোর বিচার হওয়া উচিত। এ ধরনের কর্মকাণ্ড যেন আগামীতে না হয় আমরা সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

সভায় স্থানীয় সরকার বিশেষঞ্জ ও সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘দলীয় প্রতীক নিয়ে আমাদের এখনো অবস্থান চুড়ান্ত করিনি। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হোক সেটা আমরা চাই না। এ জন্য স্থানীয় সরকারের আইন পরিবর্তন করতে হবে। আইনের পরিবর্তন না হলে এটা হবে না।’

মতবিনিময় সভায় গণমাধ্যম নীতিমালা সংশোধন করে যেকোনো উপায়ে প্রতিবন্ধকতা দূর করে খবর সংগ্রহ ও প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে বলে সাংবাদিকেরা দাবি তোলেন। এ ছাড়া নারী আসনে সরাসরি ভোট, না ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা, কমিশনের অধীনেই এনআইডি কার্যক্রম রাখা, পেশি শক্তির প্রভাব রোধ, নির্বাচন কমিশনারদের মর্যাদা মন্ত্রীর ওপরে আনা এবং প্রশাসনের পরিবর্তে ইসি কর্মকর্তাদের ভোটের দায়িত্বে আনাসহ নানা প্রস্তাব উঠে।

[237383]

মতবিনিময় সভার শুরুতে আরএফইডির সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীর আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন আয়োজন করে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে ৩২টি সুপারিশ করেন। এ ছাড়া আরএফইডির সভাপতি একরামুল হক সায়েমসহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাখেন।

সংবিধান হোক গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতের: গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতের সংবিধান চান সংবিধান এবং বিচারঙ্গণের বিশ্লেষকেরা। তারা বলেছেন, সেখানে জনগণের মতামত ও প্রাধান্য থাকতে হবে। একই সঙ্গে সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা, শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরনের বিষয়টি নিশ্চিত দেখতে চান তারা। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এলআরএফ আয়োজিত আলোচনাসভায় এসব কথা বলেন তারা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সংবিধানের খসরা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন। খসড়া প্রস্তাবনায় তিনি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা এবং প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন, আনুপাতির হারে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তাব এবং জাতীয় পরিষদ ২০০ ও সংসদে ৩০০ আসনের ব্যবস্থা রাখা, রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রীদের কেউ দুই মেয়াদের বেশি নির্বাচিত না হওয়া, জাতীয় পরিষদের নির্দলীয় সদস্যদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং সাংবিধানিক আদালত ও নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবসহ নানা বিষয়ে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।  

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন,  ‘বিপ্লবত্তোর বাংলাদেশে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছি সেটা তাদের (শহীদদের) প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা জানানো। কিন্তু আমাদের কিছু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিষয় চিন্তায় রাখতে হবে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের যদি তাকাই তাহলে এই প্রস্তাবনাগুলো (খসরা) এই সরকারের জায়গা থেকে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ আছে কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার। কেননা এই অনুচ্ছেদে আপনি সবকিছু করতে পারবেন শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া।’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম. এ মতিন বলেন, ‘যে সংবিধান ফ্যাসিস্টদের জন্ম দিয়েছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে।’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধান শুধু আইনজ্ঞদের বিষয় নয়, এটি জনগণের বিষয়। এখানে নাগরিকদেরও মতামত থাকতে হবে।’

সংবিধানের পুনর্লিখন আদৌ সম্ভব নয় এবং সে প্রক্রিয়াও সংবিধানে নেই বলে আলোচনায় উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন।    

জেষ্ঠ আইনজীবী ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘৫৩ বছরে আমরা একটা ভালো  নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। গত ১৫ বছরে আইন করে লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিবিদেরা নাগরিকদের প্রজা মনে করেন। আমরা আসলেই প্রজা হয়ে গেছি। সংবিধান বার বার ব্যর্থ হয়েছে।’

হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীরের সভাপতিত্বে আলোচনাসভায় আরও বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদ। এছাড়া ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশনসহ সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা উপস্থিত ছিলেন।

এমটিআই