ঢাকা : মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ৬৫ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।
এ তালিকায় রয়েছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ/সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকিট, রেস্তোরাঁ, পোশাক, হোটেল, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ সংক্রান্ত সংশোধিত খসড়া অধ্যাদেশের অনুমোদনের বিষয়টি বৈঠক শেষে জানানো হলেও ভ্যাটের বিষয়ে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে কিছু পরিবর্তনের বিষয়ে জানা গেছে।
এনবিআর–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে হঠাৎই ভ্যাট, সম্পূরক শুল্কসহ বিভিন্ন ধরনের কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৬৫ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে।
[240913]
বুধবার (১ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পরিষদ অনুমোদনও দিয়েছে। শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সাপেক্ষে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ থেকে ভ্যাট বাড়ানোর আদেশ জারি করা হবে বলে সূত্রটি জানায়।
জানা গেছে, ঋণ দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার (৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা) সঙ্গে যোগ হবে। বাজেট প্রণয়নের সময় এনবিআরকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে এনবিআর থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। তার ওপর আইএমএফ আরও ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় ভ্যাট হার বাড়ানোর বিকল্প ছিল না।
কোন খাতে কত বাড়ছে : আইএমএফের শর্তে ভ্যাটের পরিধি বাড়াতে নজর দিয়েছে এনবিআর। বছরে ৩০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার থাকলে ভ্যাটের খাতায় (টার্নওভার করের তালিকাভুক্তি) নাম লেখাতে হবে। বর্তমানে টার্নওভার করের তালিকাভুক্তির সীমা ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০ লাখ টাকা কমানো হয়েছে। এতে ছোট ব্যবসায়ীরাও ভ্যাটের আওতায় চলে আসবেন। একই সঙ্গে ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে।
[240922]
সহজ পন্থায় ভ্যাট আদায় করতে এবারও এনবিআর মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট খরচকে বেছে নিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় মোবাইল ফোনের সম্পূরক শুল্ক একদফা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়। এতে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭২ টাকার সেবা (কথা বলা ও ইন্টারনেট) পেতেন ব্যবহারকারীরা।
আইএমফের চাপে একই অর্থবছরে দ্বিতীয় দফায় মোবাইলের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে গ্রাহকরা ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৬৭ টাকার সেবা পাবেন, বাকি টাকা ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক হিসাবে কেটে নেওয়া হবে।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দিকেও নজর দিয়েছে এনবিআর। সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়বে। বাসা-বাড়িতে এলপিজি গ্যাসের দামও বাড়বে। কারণ এলপিজি গ্যাস সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার খরচও বাড়বে। আগামীতে সব ধরনের হোটেলে খাবার খেতে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে, যা সরকার ভ্যাট হিসাবে আদায় করবে। বর্তমানে রেস্তোরাঁয় খেতে ৫ শতাংশ এবং হোটেলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ব্র্যান্ডের পোশাক কেনার খরচও বাড়বে। কারণ তৈরি পোশাকের ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
[240926]
বিমান টিকিটের দাম বাড়বে। কারণ বিমান টিকিটের আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান টিকিটের আবগারি শুল্ক ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রুটের বিমান টিকিটের আবগারি শুল্ক ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে।
এ ছাড়া মিষ্টি কিনতে গেলেও খরচ বাড়তে পারে ভোক্তার। কারণ, মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে নন-এসি হোটেল সেবার ভ্যাট হারও বাড়তে পারে। বর্তমানে নন–এসি হোটেল সেবার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
[240915]
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অর্থনীতির সামগ্রিক বাস্তবতায় সরকারের ওপর দায়দেনার চাপ বাড়ছে। সরকারের অর্থ দরকার। তাই বিভিন্ন পণ্য–সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ কিছুটা বাড়বে, এটা সত্য। আবার আমাদের রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত খুবই কম। সেটি বাড়ানোও দরকার। এ জন্য প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সাধারণ মানুষ যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকেও নজর দিতে হবে।’
এমটিআই