জলবায়ু পরিবর্তন

দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারী

  • এমরানা আহমেদ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ১০:০৮ পিএম

ঢাকা : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনই ক্ষতিগ্র্রস্ত হয়, তবে নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্র্রস্ত হন। নারীরা এমনিতেই অরক্ষিত থাকেন। যে-কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর তারা আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়েন। কেননা যে-কোনো দুর্যোগ এবং দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে নারীরাই বেশি দুর্ভোগের শিকার হন। জলবায়ু পরিবর্তনে নারীর ক্ষতি নিয়ে নানাবিধ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আলাদা গবেষণায় এই একই ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু কেন নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়? গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, শিশু ও স্বজনদের রক্ষায় বেশি মনোযোগী এবং আর্থ-সামাজিকভাবে ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত  গ্রহণের অভাবের কারণে নারীরা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বেশি। একাধিক গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এটা কেবলই গ্রামীণ এলাকায় নারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো বিষয় নয়, বিশ্বজুড়েই পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি দারিদ্র্যের শিকার এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায় পিছিয়ে। এই বৈষম্যের কারণে কোনো দুর্যোগে যখন অবকাঠামো, ঘরবাড়ি বা কাজের ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন নারীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে, তার প্রভাব প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্টতই মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে।

বর্তমান সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৫ প্রণয়ন করেছে। উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ৬০টি উপজেলায় ১০০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং আরো ২২০টি নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩৭৮টি মুজিব কেল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ৩ হাজার ৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। আরো ১ হাজার ৬৫০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। নারী ও শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতির শিকার বেশি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে নারী ও শিশুদের বাঁচাতে এখনই কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে জাতি হিসেবে আমরা দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠব। কারণ সুস্থ-সবল মা ও শিশুই দেশের ভবিষ্যৎ। এ জন্য দুর্যোগকবলিত এলাকায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে সর্বদাই তাৎক্ষণিক আমাদের দাঁড়ানো কর্তব্য। তাদের অভাব-অনটন এবং প্রয়োজন দূর করার লক্ষ্যে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে, যাতে করে দুর্যোগকবলিত মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধরে রাখতে পারেন এবং তা নিশ্চিত করতে সকলকে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নারী ও শিশুর সামাজিক সুরক্ষাকরণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানি বেড়ে যায়। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার নারীদের সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০টি নলকূপ বসানোর কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য প্রকল্প অনুযায়ী বরিশালের মুলাদী ও মেহেন্দীগঞ্জ এবং পটুয়াখালীর বাওফল ও মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ৪০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে এবং উঁচু স্থানে টয়লেট স্থাপন করা হবে।

অন্যদিকে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যারা বাস্তুহারা এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্য ও নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বয়ের অভাব তাদের আরো ঝুঁকির মুখে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুহারা মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এখনো এ বিষয়টি নারীদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। দুর্যোগ-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় নারীদের সহায়তা করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে বহু সাইক্লোন শেল্টার বা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে, কিন্তু সেগুলো নারীবান্ধব নয়। ওই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। নেই নারীদের নিরাপত্তা। এসব শেল্টার নারীর জন্য বড় ধরনের বিপদ হয়ে দেখা দেয়। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকার ফলে কখনো কখনো কিশোরী ও নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়েও ধর্ষণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হবেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। দেশে নারী ও শিশুদের হার রয়েছে ৭০ ভাগ, অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি নারী ও শিশুকে পোহাতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝক্কি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুহারা হয়ে মানুষকে জলবায়ু অভিবাসী হয়ে দেশের ভেতরে অন্য কোনো স্থানে, কখনো কখনো দেশের বাইরেও আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যখন কোথাও নদীভাঙন দেখা দেয়, তখন ওই এলাকার পুরুষরা কাজের সন্ধানে শহরে চলে যায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখভাল করার জন্য নারীরা এলাকাতেই থেকে যায়। ঘরের কাজ ছাড়াও তাদের পুরুষদের কাজগুলোও করতে হয় সংসারে। চাষাবাদ করা, গবাদিপশুকে খাওয়ানো, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংগ্রহ ইত্যাদি নানা কাজ করতে হয় নারীদের। আবার অনেক সময় দেখা যায়, যেসব পুরুষ কাজের সন্ধানে শহরে যান, তারা সেখানে রিকশা চালানোসহ অন্যান্য কাজ করেন। এমনও হয় তাদের কেউ কেউ সেখানে আরেকটি বিয়ে করেন এবং পুরোনো স্ত্রীকে ত্যাগ করেন। ফলে নারীকে তখন নিজের সন্তানসন্ততি তো বটেই, যে স্বামী তাকে ত্যাগ করেছেন, তার বাবা-মা, ভাইবোনদেরও দেখভাল করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো এই পরিবারের ভাঙন, সেখানে নারীদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি।

তবে কোনো কোনো দুর্যোগে নারী ও পুরুষের ক্ষতির পরিমাণে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। যখন কোনো ঘূর্ণিঝড় আঘাত  হানে বা নদীভাঙনে ভিটেমাটি-ঘরবাড়ি তলিয়ে যায় বা খরা দেখা দেয়, তখন নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীদের দুর্ভোগের মাত্রা আলাদাভাবে নিরূপণ করে এর সঠিক অনুপাত নির্ণয়ে গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত প্রকট এবং যেখানে নারীরা এখনো নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের জেন্ডার প্রেক্ষিত এখন দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি নারীদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের নারীর দুর্ভোগের বিষয়টি আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ বিষয়ে দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং স্থানীয় এনজিওগুলোকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তৃণমূল পর্যায়েও একটি কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। সরকারের এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার সাথে সাথে গণমাধ্যমের এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো রাষ্ট্র ও সরকারকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং জেন্ডার ইস্যু ও জলবায়ুর পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা  করা সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মানুষ, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থের ব্যবস্থা গ্রহণ করার পক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশ  বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা ২০০৯ (বিসিসিএসএপি,২০০৯) চূড়ান্ত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম এ ধরনের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিসিসিএসপি ২০০৯-এ বর্ণিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশ থেকে অর্থ প্রাপ্তির অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় মুজিববর্ষে সরকার এক কোটি বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমরা নিশ্চিত, সরকারসহ আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চই আমরা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের বিশেষ করে নারী-শিশুদের সুরক্ষায় সফল হব।

(পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)