ঢাকা : যদি বলা হয় একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতির জন্য সবচাইতে বড় হূদয়বিদারক ট্র্যাজেডি কী? তাহলে শুরুতে আসবে কোভিড-১৯ মহামারীর কথা। যার প্রভাবে এখনো প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষকে পার্থিব জীবনের মায়া ত্যাগ করে পরকালীন ভুবনে পাড়ি জমাতে হচ্ছে। মানুষকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে জনজীবনে স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে আনাই এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষের কাছে কোনো কিছুই অসাধ্য নয় বলেই বিজ্ঞ গবেষক ও অভিজ্ঞ ডাক্তারদের প্রচেষ্টায় বহুলপ্রতীক্ষিত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ টিকাদান শুরু করলেও জনজীবনে টিকা নিয়ে সংশয়ের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সাধারণত যে-কোনো টিকারই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। যেমন, শরীরে ইনজেকশন দেওয়ার স্থানটি লাল হওয়া বা ফুলে যাওয়া, অবসাদ, জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি। তবে এর কোনোটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়। শরীরে টিকার কার্যকারিতা শুরু হলে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় এমন প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। অনুমোদন পাওয়া করোনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। যেসব রোগের যেমন যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস-বি ইত্যাদির ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আর করোনা ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একই বলেছেন গবেষকরা। করোনা ভ্যাকসিনও অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক সব ধরনের যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে এবং নিরাপদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তাই গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে। যেমন, যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচি চালুর পর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুজনের অ্যালার্জি দেখা দেয়। দেশটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সমস্যা যাদের আছে তাদের সতর্ক করেছে। তবে সার্বিকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেই করোনার টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি, যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সাধারণত টিকায় দুর্বল বা মৃত ভাইরাস থাকে, যার মাধ্যমে শরীর সেই ভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। তবে করোনার টিকাগুলো প্রথমবারের মতো এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি। এতে কোনো ভাইরাস থাকে না। তার বদলে কোভিড-১৯-এর জীবাণুর ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিরূপ থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বায়োনটেক-ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা-এই তিন টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এর বাইরে রাশিয়া স্পুটনিক ৫ ও চীন সিনোভ্যাক টিকার অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদন পর্যায়ে বায়োনটেক-ফাইজার উদ্ভাবিত টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকা গ্রহীতা সাময়িক অবসাদ আর মাথাব্যথায় ভুগেছেন এমন কিছু সাময়িক লক্ষণ দেখা গেছে। এমআরএনএ ভ্যাকসিনটির ব্যবহার শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে একজন ও ব্রিটিনে দুজনের ত্বক লাল হওয়া এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল। যাদের অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে তাদেরকে সতর্ক করেছে ব্রিটিশ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি। বায়োনটেক ফাইজারের মতোই এমআরএনএ ভিত্তিক মডার্নার টিকাটি। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকা গ্রহীতাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। হালকা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো ছিল সাময়িক। তবে ১০ শতাংশ অবসাদে ভুগেছেন বলে জানিয়েছে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক প্যানেল। অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একজন মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভুগেছেন। সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর কিছুদিন ট্রায়াল বন্ধ ছিল। কিন্তু পরে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরীক্ষার পর জানিয়েছে সেটির কারণ ভ্যাকসিন নয়। এছাড়া টিকাটি নেওয়ার পর ইনজেকশনের স্থানে ও পেশিতে ব্যথা, মাথাব্যথা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম ছিল। সর্বোপরি এখন পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে সেগুলোর কোনোটিই আসলে পরিপূর্ণ ঝুঁকির চিত্র তুলে ধরছে না। দীর্ঘ মেয়াদে টিকাগুলোর ব্যবহার মানবদেহে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা অজানা। সেটি হয়তো সামনের মাস বা বছরগুলোতেই পরিষ্কার হবে।
করোনা হলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাই বলে মৃত্যুর সম্ভাবনা একেবারেই কম নয়। একবার আক্রান্ত হলে তার প্রভাব শরীরের মধ্যে থেকে যায় বলে দেখা গেছে। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব লোক করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন, তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রতি ৩ জনের ১ জন আবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে। তাদের প্রতি আটজনের একজন মারা গেছেন। একবার আক্রান্ত হলে লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুস ও শরীরের অন্য অর্গানগুলো আক্রান্ত হয় বলে দেখা গেছে। এ গবেষণাটি প্রিলিমিনারি, যত সময় যাবে ক্ষতির ধরন আরো পরিষ্কার হবে।
করোনা আক্রান্ত হলেও টিকা নিতে হবে। কারণ একবার সংক্রমিত হলে পরে আর হবে না এমন কোনো নিশ্চিয়তা নেই। বরং একবার আক্রান্ত হওয়ার পর আবার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। আবিষ্কৃত তিনটি টিকার ক্ষেত্রে যে টিকাই আপনি গ্রহণ করেন না কেন তা দুই ডোজ করে নিতে হবে এবং ডোজ দুটি একই টিকার হতে হবে। কারণ দুই ডোজের দুই ধরনের টিকা গ্রহণের ক্ষতি স্পষ্ট না, তাই চিকিৎসকরা আপাতত গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। শুধু করোনা আক্রান্ত অবস্থায় এবং সাধারণ সর্দি, কাশি, ও জ্বর থাকলে সে সময় টিকা নেওয়া যাবে না। যাদের এলার্জি আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে পারবেন বলে নিশ্চিত করেছে গবেষকরা। টিকাগুলো ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সিদের দেওয়ার জন্য অনুমোদন পেয়েছে। শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে গবেষণা চলছে বলে জানিয়েছেন জার্মান রবার্ট কেএল ইনস্টিটিউট। টিকা হালাল হওয়ার ব্যাপারে ফাইজার, মর্ডানা, অ্যাস্ট্রাজেনেকার মুখপাত্ররা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে নিশ্চিত করেছেন তাদের টিকায় শূকরের কিছু নেই। মুসলিম স্কলারগণ এই বিষয় মত দিয়েছেন যে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় শূকরের কিছু থাকলেও জীবন বাঁচাতে তা গ্রহণ করা যাবে।
ভ্যাকসিন নিলে আমরা রোগ থেকে সুরক্ষা পাব। একটা ভ্যাকসিন যখন আপনাকে রোগে আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে তখন আপনি সে রোগ অন্যের মাঝে ছড়াতে পারবেন না। ভ্যাকসিন নেওয়ার আরেকটা বিবেচনাযোগ্য দিক হলো, একটা সমাজে যখন যথেষ্ট মানুষ ভ্যাকসিন দ্বারা সুরক্ষিত হবে তখন সেই রোগ আর ছড়াতে পারবে না। এর মাধ্যমে যারা ভালনারেবল বা দুর্বল অর্থাৎ শিশু যাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে, বয়োবৃদ্ধ, গর্ভবতী মহিলা বা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে এমন নারী তারা সুরক্ষিত থাকতে পারবে। এ মানুষগুলোর চারপাশে আমরা যারা আছি তারা যদি ভ্যাকসিন গ্রহণ করি তাহলে তাদের চারপাশে একটা সুরক্ষার দেয়াল তৈরি হবে। এই সুরক্ষার দেয়াল তাদের এমন একটা রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে যা তাদের মৃত্যু ঘটাতে পারে। যে রোগ আমাদের থেকে এত মানুষ কেড়ে নিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভ্যাকসিন নামক মোক্ষম একটা অস্ত্র পেয়েছি। সরকার এই মোক্ষম সুযোগকে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহযোগিতায় ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত কোভিশিল্ড টিকা জনসাধারণের জন্য নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এ অস্ত্র যদি আমরা হাতে তুলে না নেই তখন করোনা ভাইরাস দুর্বল বা ভালনারেবল মানুষদের আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন না নিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া কি যুক্তিযুক্ত হবে?
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়