জন্মশতবার্ষিকীতে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি

  • মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২১, ০১:৩২ পিএম

ঢাকা : কত শতসহস্র বছর পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে ছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা। আধাপেটা একবেলা খেয়ে নেংটি পরা এদেশের কৃষক শ্রমিক আমাদের সবার অন্নসংস্থানের কাজটি করে গেছেন যুগের পর যুগ ধরে। মানুষ হিসেবে কোনো মূল্য কোনোদিন পাননি তারা। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া এক যুবক শেখ মুজিবুর রহমান খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের লক্ষ্যে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ালেন।

ভুখানাঙ্গা মানুষের জন্য একটি স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হলেন তিনি। সংগঠিত করলেন এদেশের মানুষকে। বার বার জেল খাটলেন, নির্যাতনের শিকার হলেন তবু মাথা নোয়ালেন না। অবশেষে তারই নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিল এক স্বাধীন দেশ- বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশের কৃষক এবার মাঠের সবুজ জমিনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর অধিকার লাভ করে।

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কৃষি আর কৃষক পায় অভূতপূর্ব আনুকূল্য। কৃষিবান্ধব সরকার, কৃষিবিদ আর কৃষক মিলে এদেশের মাঠ ভরে ওঠে ফসলে ফসলে। স্বাধীনতা যেন ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। জাতির পিতার বাংলাদেশে কৃষি আর কৃষক আজ এক নতুন গন্তব্যের অনুগামী। সংস্থান হচ্ছে খাদ্যের, সংস্থান হচ্ছে পুষ্টিরও। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের কৃষি আজ এক অন্য মাত্রায় উন্নীত।

এদেশের কৃষি ও কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অহর্নিশি এদেশের কৃষকের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা ছিল তার বড় ভাবনা। কৃষকরাও তাকে ভালোবেসেছে অকৃত্রিমভাবে। এদেশের মানুষের মনে তিনি এক অক্ষয় মানব। বঙ্গবন্ধু মিশে আছেন এদেশের জল, হাওয়া আর মৃত্তিকার সঙ্গে। মিশে আছেন এদেশের বিস্তীর্ণ মাঠে-প্রান্তরে আর ফসলের ক্ষেতে। কৃষক আর কিষানির হাসিমাখা মুখ যেন বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। আমাদের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে মিশে থাকা এক নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের গল্প- গাথায় শিল্প-সাহিত্যে তাই অনিবার্যভাবে আঁকা হয়েছে তাঁকে নিয়ে কত রকম চিত্র।
এবার শস্যচিত্রে অন্য এক অভিধায় অঙ্কিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।

বাংলার শস্যক্ষেতের বিশাল ক্যানভাসে নতুন এক মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। আমাদের প্রধান ফসল ধানের দুই বর্ণের জাতের চারা মাঠে এক শৈল্পিকরূপে রুয়ে দিয়ে আঁকা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সে জীবন্ত মুখচ্ছবি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেধা ও মননের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে এ শিল্পকর্ম। সে যেন এক ভিন্নমাত্রার শিল্পকর্ম, যাকে কিনা বলা যায় স্থাপনা শিল্প। এদেশে এরকম ব্যতিক্রমী বিশালাকৃতির শিল্পকর্ম এটিই প্রথম। বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের বালেন্দা গ্রামের ১০৫ বিঘা জমির ওপর প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতিহাসের বৃহত্তম বঙ্গবন্ধুর সে মুখচ্ছবি।

এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল শস্যচিত্র হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশাবাদ ছিল। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের শুরু হয় বাস্তবে বেশ আগে থেকেই। জায়গা নির্ধারণ, সেখানকার বিশাল চত্বরে ১০৫ বিঘা জমির ওপর ১২ লাখ ৯২ হাজার বর্গফুট আয়তনব্যাপী শস্যচিত্রে ইতোমধ্যে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। শস্যচিত্রটির দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার আর প্রস্থ ৩০০ মিটার। নকশা মোতাবেক চারা লাগানো হয়েছে সেখানে যথাসময়ে। দুই বর্ণের চারা বড় হতে হতে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবিটি ফুটিয়ে তুলেছে। বাংলার উর্বরা মাটি থেকে বেড়ে ওঠা ধান গাছের বর্ণিল আভায় ভেসে উঠেছে বাঙালির প্রাণপুরুষ জাতির জনকের মুখচ্ছবি।

জাতির পিতার প্রতি তার জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা জানানোর এটি হবে এক অভিনব শিল্পকর্ম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখার এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি সংস্থা ‘ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার’।

পুরো চিত্রকর্মের লেআউট বা নকশাটি সম্পন্ন করেছেন কয়েকজন কৃষি প্রকৌশলী। নকশা অনুযায়ী চারা রোপণের জন্য আড়াই ফুট দৈর্ঘ্যের খুঁটি যথাস্থানে স্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবির বিভিন্ন অংশ ফুটিয়ে তোলার প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)-এর একশ সদস্য। শস্যচিত্রের ধান গাছের পরিচর্যায় ছিলেন সেখানকার ১৫০ জন কিষান-কিষানি। তাদের সবার শ্রমে ঘামে আর মমতায় ধানের চারা বেড়ে উঠেছে নির্দিষ্ট মাত্রায় আর তাতে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর বর্ণময় মুখচ্ছবিটি। বালেন্দা গ্রামের বিস্তীর্ণ জমি লিজ নেওয়া হয়েছে সেখানকার কৃষকদের কাছ থেকে। সমতল এই বিস্তীর্ণ জমি হলো শস্যচিত্রের প্রাথমিক ক্যানভাস। দুই বর্ণের হাইব্রিড ধান জাতের চারা এই শিল্পকর্মের প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ধানের বেগুনি বর্ণের এফ-১ হাহব্রিড ধানের চারা আনা হয়েছে চীন থেকে। আর সবুজ বর্ণের হাইব্রিড জাতের ধান ‘জনকরাজ’ সরবরাহ করেছে ‘ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার’।

পরিকল্পনা ও নকশামাফিক সেসব দুই বর্ণের চারা রোপণ করা হয়েছে জানুয়ারির ২৯ তারিখে। অতঃপর কৃষকের সস্নেহ পরিচর্যায় বেড়ে উঠেছে সবুজ আর বেগুনি বর্ণের ধান গাছ। ধানশস্য পাকতে শুরু করেছে বলে বঙ্গবন্ধুর গোঁফ, চোখ, মাথা হয়ে উঠেছে খয়েরি বর্ণের আর মুখচ্ছবির অন্য অংশ হয়ে উঠেছে সোনালি বর্ণের। দুই বর্ণের মিশেলে ধান গাছকে অবলম্বন করে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর বিশালাকৃতির মুখচ্ছবি। সে বাস্তবেই এক অনন্য শিল্পকর্ম। অভিনব, নান্দনিক ও প্রাকৃতিক। ১৭ মার্চ ছিল বাংলার কিংবদন্তিতুল্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একশ একতম জন্মবার্ষিকী। এখনো চলছে সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীর নানা কর্মসূচি।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এক মাহেন্দ্রক্ষণে শস্যচিত্রে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বিশালতর এক ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। ধানের চারার শৈল্পিক বিন্যাস আর এদের কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধি ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে তুলেছে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। ইতিহাসের গর্বিত অংশ হওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে এই শস্যচিত্রটি। গিনেস কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে সব ডকুমেন্ট।

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞকে এই শস্যচিত্রের সামগ্রিক তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে জমা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ। আকাশ থেকে শস্যচিত্রের সচিত্র প্রতিবেদন পাঠানোর আয়োজনও সম্পন্ন। অপেক্ষা শুধু সেই শুভক্ষণের, গিনেস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের ঘোষণার।

লেখক : সভাপতি, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, ঢাকা