ঢাকা : জাহানারা ইমামের জন্ম ৩ মে, ১৯২৯ এবং মৃত্যু ২৬ জুন ১৯৯৪। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়াগো স্টেট কলেজ থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি নিয়েছেন। ময়মনসিংহ শহরে বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে তিনি তার কর্মময় জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনলিপি, মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’। কলাম লিখতেন দৈনিক বাংলায়।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাফী ইমাম রুমী বীর বিক্রম তার জ্যেষ্ঠ সন্তান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রুমী অংশগ্রহণ করেন; তিনি ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার দলের নাম ক্র্যাক প্লাটুন। রুমী ছাড়াও ক্র্যাক প্লাটুনের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন- আযম খান, কাজী কামাল উদ্দিন বীর বিক্রম, গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ঢাকায় বোমা ফাটিয়ে এরা মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ব দরবারে জানান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জাহানারা ইমাম নিজে গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তার বাড়ির দ্বার ছিলো উন্মুক্ত। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। রুমীর এমন আত্মত্যাগে তিনি শহীদ জননীর মযার্দায় মহিমান্বিত হন।
গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে জামায়াতে ইসলামের আমীর গোলাম আযমের বিচারের উদ্যোগ নেন জাহানারা ইমাম। গণআদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিরীহ মানুষকে হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলও এমন গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারের আয়োজন করেছিলেন। গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামের নেতাদের নেতৃত্বে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে রাজাকার, আল শামস, বদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এই তিন বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতে ইসলামের গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা প্রমুখ। গ্রামের সাধারণ জনতা আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী সম্পর্কে খুব বেশি অবহিত ছিল না, কারণ শহর এলাকায় আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু ‘রাজাকার’ ছিলো দেশের সর্বত্র, সবার কাছে রাজাকার ছিলো একটি আতঙ্কের নাম। এক সময় এই শব্দটি ডুবতে বসেছিলো, নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ তার ‘বহুব্রীহি’ নাটকে একটি পাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ শব্দদ্বয়ের উচ্চারণ করিয়ে আবার জাগিয়ে তুলেছেন।
স্বাধীনতার পর জামায়াত ও মুসলিম লীগের যারা মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে সরাসরি জড়িত ছিল তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়; পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার কারণে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। স্বাধীনতার পরপর জামায়াত ও মুসলিম লীগের লোকজন জীবন বাঁচাতে একেবারেই নিষ্কৃয় ছিল; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তারা আবার ধর্মের আচ্ছাদনে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে থাকে। শুধু তাদের একক তৎপরতা নয়, বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসেই বাঙালির মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেয়ার কসরৎ শুরু করে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট রাজনীতির মাঠে স্বাধীনতা বিরোধীদের অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ায় এরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে। পাক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলশামস, আলবদরসহ সকল যুদ্ধাপরাধীই তখন বাংলাদেশটাকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠে। পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আযম নির্ভয়ে বাংলাদেশে পদার্পনে সাহসী হয়ে উঠেন এবং জিয়াউর রহমান তার আগমনে সম্মতি দিয়ে একটা নতুন ইস্যুর জন্ম দেন।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত বাংলাদেশ বেতার, জয়বাংলা, জাতীয় সঙ্গীত, ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধ সকল বিষয়ই তখন অপাঙ্তেয়। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগের লোকগুলো পাকিস্তান আমলের চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ে। পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলাম আমীর ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার সাথে সাথে জাহানারা ইমাম রাস্তায় নেমে এলেন, সবাইকে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অদম্য শক্তি যোগালেন। নিজে ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও সমাজের ক্যানসারের বিরুদ্ধে তিনি লড়ছেন অদম্য সাহস নিয়ে, প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রগতির ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালদের পুনর্বাসনে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’।
অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের প্রেরণার উৎস জাহানারা ইমাম। জাহানারা ইমামের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখন তাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার মুক্তিযোদ্ধা মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদের সাথে জাহানারা ইমামের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রে আমাকে অনেকবার জাহানারা ইমামের এলিফ্যান্ট রোড়ের বাসায় বিভিন্ন বইপত্র ও ডকুমেন্ট নিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক সময় জাহানারা ইমামকে তার বাসা থেকে সংসদ ভবনের পাশে মিনিস্টার্স হোস্টেলে মেজো ভাইয়ের সরকারি বাসায় নিয়ে আসতে হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির মধ্যে অনেক কথোপকথন হয়েছে। অনেক সময় তার কথা বুঝতাম না, সব সময় তার জিহ্বা নড়তো, মরণব্যাধি ক্যানসারের আক্রমণে তিনি স্পষ্ট উচ্চারণের ক্ষমতা হারিয়েছিলেন, খুব অন্তরঙ্গ মানুষেরাই শুধু তার কথা বুঝতো। আমি যে তার কথা বুঝতে পারছি না তা কিন্তু আমি তাকে কখনো বুঝতে দিইনি। তিনি আমাকে ‘বিটু’ নামে ডাকতেন। আমি গাড়িতে তার পাশাপাশি বসে উপলব্ধি করেছিলাম, ক্যানসারের সাথে অবিরত যুদ্ধ করেও তিনি একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়নে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে মনোবল হারাননি।
জাহানারা ইমাম আমৃত্যু লড়াই করেছেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তাই তিনি রুমীকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা, তুই যুদ্ধে যা’। পুত্র রুমীকে জাহানারা ইমাম আর জীবিত ফেরত পাননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় ও পিটিয়ে মেরে ফেলে। তার স্বামীও পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিজয়ের কয়েকদিন আগে মৃত্যুবরণ করেন।
জাহানারা ইমাম নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। জাহানারা ইমামদের মতো ব্যক্তিদের আসলে মৃত্যু নেই, তাদের কর্মই তাদের বাঁচিয়ে রাখে। ’একাত্তরের দিনগুলি’র জীবন্ত বর্ণনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রাবাহিত হয়ে জাহানারা ইমামকে অমর করে রাখবে।
আজও জেমসের গানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে ‘স্বাধীনতা তুমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি’। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির বহুভাষিক মুখপত্র অনলাইন বুলেটিন ‘জাগরণ’ জাহানারা ইমামের কৃতিত্বকে জাগ্রত রেখেছে। বাঙালি জাতির একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে রাজনীতির মাঠে তার আবির্ভাব অত্যাবশ্যকীয় বিবেচিত হয়েছিল, কিন্তু জাতি সংকটমুক্ত হওয়ার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক