সত্য কথনে পিছপা কেন? 

  • মো. আসাদুজ্জামান | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম

ঢাকা: আমি রাজনীতির মাঠের একজন সাধারণ কর্মী। দেশবাসী সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে জানেন মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মী মিলিয়ে ৫ আগষ্টের পরে প্রায় ৬২৬ জনকে ক্যান্টনমেন্টে আটক করা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের সাহেবকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে আটক করা হয়েছে এটা প্রচারিত হয়েছে টিভিতে। সুতরাং এসব নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।

এখন আবার কিছু ভিডিওতে যুবদল, ছাত্রদল, অমুকদলের নেতা ওপারে যেতে সহযোগিতা করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এসব হলো মানুষের মতিগতি বা মনোযোগকে ডাইভার্ট করার অপকৌশল মাত্র। মূল বিষয় হলো, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছাড়া হলো কোন আইনে বা কার নির্দেশে? এ বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য সব দল নিরব কেন?  এর মানে "ভাসুরের নাম কেউ মুখে নিতে চায় না"।

দেখুন এই বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোন উকিল ব্যারিস্টার হাইকোর্টে রিট বা প্রশ্ন তুললো না? 

অথচ "টক শো" বা রাজনৈতিক মিটিং এ অনেক ঝড় তুলছে। খোদ অনেক সাবেক সামরিক আমলারাও।

[241053]

আবার গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃবৃন্দ অথবা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দও এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো প্রশ্ন তুলছে না। বিষয়টি কি এতই স্পর্শকাতর? সত্য কথা বলার সৎ সাহস না থাকলে রাজনীতি করার কি দরকার?

অন্যদিকে জামায়াতের আমির তো ঘোষণা দিয়ে বসলেন, "জামায়াত আর সেনাবাহিনী ছাড়া আর কেউ দেশপ্রেমিক নয়। আবার ৫ই আগষ্টের পরে আমির সাহেব বললেন আমরা প্রতিহিংসা পরায়ন হবো না। সব মাফ করে দেয়া হলো। এই বিচারের ভার উনাকে কে দিয়েছে?

খোদ কালের কণ্ঠের অফিসে আমির সাহেব দলবল সহ স্বয়ং উপস্থিত হয়ে নিন্দা জ্ঞাপন করলেন এর কারন জনগণ নিশ্চয় বোঝে। অথচ এই পত্রিকার মালিক পক্ষ স্বৈরাচারী হাসিনাকে প্রকাশ্য মিটিং এ বলেছিলেন "পরপারেও আমরা আপনার সাথে থাকতে চাই "। এই জামায়াত ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মালেক মন্ত্রীসভায় ছিলেন। গোটা দেশ যখন পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে, ঠিক সে সময় জামায়াতিরা তাদের পক্ষ নিয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি বাহিনী গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে এদেশের মানুষকে হত্যা করে মালামাল লুণ্ঠন করে এবং মা বোনের ইজ্জত তুলে দেয় পাক বাহিনীর হাতে। 

১৪ ডিসেম্বর ৭১ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা সরবরাহ করে পাক বাহিনীকে এবং অনেককে ধরিয়ে দেয় হত্যার জন্য। এরা আবার দাবী করে এরা নাকি দেশপ্রেমিক। মানুষ এইসব রাষ্ট্রদ্রোহীদের ভুলে নাই। ভুলবেনা। ইতিহাস চিরকাল সাক্ষী দেবে। এ কারণেই এরা পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি আজও। আইয়ুব খাঁনও এদের রাজনীতি বন্ধ করেছিল। কুরআনে কোথাও জামায়াতে ইসলাম বলে শব্দ নেই।

৫ই আগষ্টে ও তারপরে দল বেঁধে রাজনৈতিক দলগুলো, বিপ্লবী ছাত্রনেতৃবৃন্দ, জনাব আসিফ নজরুল জুনায়েদ সাকীসহ অনেকেই জেনারেল ওয়াকার সাহেবের ওখানে গেলেন মিটিং করলেন। সকলেই সেনাবাহিনীর প্রসংসায় একেবারে গদগদ। সরকার গঠন সংক্রান্ত আলোচনা করলেন। ৮ ই আগষ্ট সরকার গঠন করলেন। বেশ ভালো কথা। কেউ কেউ খুশি হলেন আবার কেউ কেউ নিরাশ হলেন সরকারে জায়গা না পেয়ে।

[241068]

পরবর্তীতে আবার কেউ কেউ বলছেন বিপ্লবী সরকার গঠন বা ঘোষণা না করা ভুল হয়েছে। যারা বলছেন তাদের পরিবারের কেউ আবার সরকারেও আছেন। অথচ মাঠে ময়দানে আবার সমালোচনা করছেন। এটা কি দ্বিচারিতা বা ডাবলস্টান্ডার্ড নয়? 

অল্পবয়স্ক বা অপরিপক্ক অনভিজ্ঞ ছাত্রদেরকে বুদ্ধিশুদ্ধি দিয়ে যারা তাদরকে বিপথগামী করছেন তাদের বিচার করবে কে? নিশ্চয়ই ইতিহাস একদিন তাদের বিচার করবে। 

তিনদিন তো দেশে কোন সরকার ছিলো না। আরেকটু অপেক্ষা করে বিপ্লবী সরকার গঠন করলে কি স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব হারিয়ে যেতো? নিশ্চয়ই না।

কার ইশারায় কেন তাড়াহুড়ো করে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হলো জনগণের কাছে তা পরিষ্কার নয়।এতো অপরিপক্ক অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ উপদেষ্টা পরিষদ কেন কার প্রস্তাবে বা কাদের প্রস্তাবে গঠিত হলো জনগণ তা জানতে চায়? 

মাত্র কয়েকদিন আগে দৈনিক নিউ এইজ এর সম্পাদক জনাব নূরুল কবির সাহেব সাক্ষাৎকার নিলেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের।

এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বললেন, "আমি রাজনৈতিক অঙ্গনের লোক না। রাজনৈতিক বিষয়ে পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, মানুষের পারসেপশন আপনাদের সম্পর্কে এরকম"। তার উত্তরে তিনি বললেন, আমরা চেষ্টা করছি নিয়ন্ত্রণের।

জনগণ জানে আপনাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু ওই কথায় তো চিড়ে ভিজবে না। ৫ মাস চলে গেছে কিন্তু আইন শৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন? এর সুনির্দিষ্ট জবাব জনগণ জানতে চায়।

আপনার নোবল প্রাইজ বা থ্রিজিরো থিউরি দিয়ে তো মানুষের পেট ভরবে না? কথাগুলো কষ্টদায়ক কিন্তু মানুষের কষ্ট এর চেয়ে বেশি। 

সবচেয়ে ভালো হয় আপনি ক্ষুদে মাঝারি রিটেইলার, সাপ্লাইয়ার, ইম্পোর্টারদের ডাকুন ও তাদের সাথে পরামর্শ করুন। রাস্তঘাটের চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য পুলিশ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তি, কর্মকর্তা ও সেনাসদস্য নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন। ম্যাস-মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরন কর্মসূচি নিন।পদত্যাগ করা বা ছেড়ে চলে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। কাপুরুষতা মাত্র। 

কর্মকর্তাদের ভয়ভীতির কথা না বলে উদ্বুদ্ধ করুন। সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার শক্তি যোগান দিন। কোনো দলমতের দিকে ঝুঁকে না পড়ে নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস দিন। যারা দখলদারি চাঁদাবাজি করছে তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিন।

তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আইন প্রয়োগে কিছুটা পিছুটান থাকবে, কেননা তারা এসবের পূর্বে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে ভাবে। তারা মনে করে এইদিন দিন নয় আরো দিন আছে। আর লুটেরা পক্ষ পার্শ্বে থেকে বলে দেখে নিবো তোমাকে। চাকুরীজীবিরা অধিকাংশই সাধারণ কৃষক শ্রমিক পরিবারের ছেলে তাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে? রাষ্ট্রের সব অঙ্গগুলোতো ভেঙ্গে পড়েছে, পঁচে গেছে। সুতরাং এগুলোকে ঠিক করতে হলে যথেষ্ট সময় দরকার। নিদেনপক্ষে পাঁচ বছর। কিন্তু সে সুযোগ কি যারা ক্ষমতায় যেতে চায় তারা দেবে? নিশ্চয় না। কারন তারা ইতোমধ্যে দ্রুত নির্বাচন চায় এবং নির্বাচনের জন্য দরকার হলে আরেকবার সংগ্রাম করতে হবে বলে কর্মীদের তৈরী হতে বলছেন।

এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও ছাত্রনেতারা চব্বিশের আগষ্ট ঘোষণা চেয়ে আল্টিমেটাম দিয়েছে সরকারকে। অথচ তাদেরই সমর্থিত সরকার যেখানে তাদের প্রতিনিধি আছে। কতবড় বৈপরীত্য তা আপনারা বুজতেই পারছেন।

ছাত্ররা দল গঠনের ঘোষণা যদি না দিতো তাহলে পরিস্থিতি হয়ত বা তাদের অনুকুলে থাকতো। তারা সরাসরি ক্ষমতায় যেতে চায় এবং রাষ্ট্র-সংস্কার বাস্তবায়ন করতে চায়।

তাদের যুক্তি দলীয় সরকার ক্ষমতায় গেলে সংস্কার সম্ভব নয়।কারণ অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে বরং রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় বা সংবিধানে জনগণের যেটুকু অধিকার ছিল তাও কার্টেল করতে চায়। অন্ততঃ বাংলাদেশের ইতিহাস তো তাই বলে। শংকা বা ভয়টা এই জায়গায়।

আরো ভয়ংকর বিষয় হলো ছাত্ররা অধিকার আদায়ের আন্দোলন কি করতেই থাকবে? তাহলে তাদের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার প্ল্যান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির কি হবে? 

এমনিতেই কোয়ালিটি শিক্ষা তো উধাও প্রায়। একটা পুরো জেনারেশন নষ্ট প্রায় (এটা আমার ব্যাক্তিগত মতামত)। ছাত্রদেরকে আমরা কোয়ালিটি শিক্ষা, সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে না তুলতে পারলে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাবে না, বিশ্ব জব মার্কেটে কম্পিটিশন করতে পারবে না। অন্যদিকে ইন্ডিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখবো তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন অরগানে, আই,এম,এফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে লিড দিচ্ছে। তাছাড়া মাইক্রোসফট ,আমাজন, টেসলা, ফেইসবুক সহ অসংখ্য ওয়ার্ল্ড ফেমাস কোম্পানির সিও হিসেবে কাজ করছে।

সুতরাং শুধু শুধু ভারত বিরোধী কথা বলে সাময়িক সস্তা পপুলারিটি অর্জন করা সম্ভব হলেও আমরা তাদেরকে ডিঙ্গাতে পারবো না। তাছাড়া পৃথিবীর বড়বড় অর্গানাইজেশনে বা কোম্পানিতে তারা মিড লেভেল বা লোওয়ার মিড লেভেল ম্যানেজারিয়াল পজিশনগুলো অর্জন করেছে। সুতরাং আমাদেরকে ভারতের আধিপত্যকে খর্ব করতে হলে শিক্ষায় ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে। আর ছাত্রদের অতিশীঘ্র পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় আমরা আরো তিমিরে ডুবে যাবো।

পরিশেষে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মতামত রেখে শেষ করছি।
সেনা কর্মকর্তা বা লিডারগণ দূরে বসে সব দেখছেন। ইতোমধ্যে অল্প সময়ের জন্য তারা মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার পেয়েছেন কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাও দখলদারী চাঁদাবাজি কমছে না।

তাহলে প্রশ্ন আসে, তারা কি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না? অতীতে সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিলো কিন্তু এ রূপ প্রশ্ন উঠেনি। তাহলে আজ এ প্রশ্ন আসছে কেন? স্বভাবতই জনগণ মনে করে নিশ্চয়ই কোথাও কোনো গ্যাপ আছে? 

সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্বের প্রতীক। অতীত সরকারগুলো বিশেষ করে হাসিনা সরকার তাদেরকেও নৈতিকভাবে দূ্র্বল করেছে। তাদের গৌরবের অতীত কিছুটা ম্লান হয়েছে, বিতর্কিত হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহকে সচেতন জনগণ ও সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশ ষড়যন্ত্র মনে করে। অতীতের তদন্ত রিপোর্ট গুলো মানুষ বিশ্বাস করে না বরং মনে করে আই-ওয়াশ।

তবে এবারে যে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে তার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আছে বিশেষ করে কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান সাহেবের প্রতি। কেননা তিনি সাহসী, সৎ, অভিজ্ঞ এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

জনগণ ও স্বজনহারা সেনা পরিবারগণ এবার হয়তবা সঠিক মূল্যায়ন ও রিপোর্ট পাবেন।

লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও আহবায়ক-কাঙ্খিত বাংলাদেশ। 
(আমার এই লেখাটি ২৪-এর অভ্যুত্থানে ও বিডিআর হত্যাকাণ্ডে নিহতদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম)

আইএ