সংঘাত-সংশয়ে চলছে নির্বাচন, নিহত ২

  • চট্টগ্রাম ব্যুারো | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২১, ০১:৪৫ পিএম

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে পৃথক সংঘর্ষে দুই জন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন।

বুধবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে দশটার দিকে নগরের পাহাড়তলীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এক কর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতের নাম আলাউদ্দিন। নিহত আলাউদ্দিন আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের অনুসারী।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সিএমসিএইচ) পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সংঘর্ষের পর বঙ্গবন্ধু বাংলা স্কুলে ভোটগ্রহণ প্রায় এক ঘন্টা স্থগিত ছিলো বলে নিশ্চিত করেছেন সে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার।

অন্যদিকে সকালে নগরীর ১২নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর দ্বন্দ্বে আপন ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন নিজাম উদ্দিন মুন্না নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী।  সকাল ৮টার দিকে বার কোয়াটার ডায়মন্ড টার্চ কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পাহাড়তলী থানার ওসি (তদন্ত) রাশেদুল হক, হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

স্থানীয়রা জানায়, নিহত যুবক মুন্না ১২ নম্বর ওয়ার্ডের (সরাইপাড়া) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী সাবের আহমদের কর্মী ছিলেন। তার ভাই হত্যাকারী সালাউদ্দিন কামরুল একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিনের কর্মী। নির্বাচন নিয়ে দুইভাইয়ের মধ্যে কিছুদিন ধরে বিরোধ চলছিল। আজ সকালে ভোট শুরুর আগেই দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলে মুন্নাকে ছুরিকাঘাত এবং গলাকেটে হত্যা করে পালিয়ে যায় কামরুল। পুলিশ মুন্নার লাশ উদ্ধার করেছে।   

দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, গোলাগুলি : নগরীর আসাদগঞ্জে দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার সকালে ভোট শুরুর পরপরই এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড আসাদগঞ্জ ছোবাহানীয়া আলীয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। এতে দুজন আহত হয়েছে।

এ সময় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। তবে বড় কোন ঘটনা নয় দবে দাবি করেছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি সকাল থেকে ভালো। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও দেখছি।’

লালখান বাজারে সংঘর্ষ, আহত ২০ : লালখান বাজারে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে থেমে থেমে সংঘর্ষ এখন পর্যন্ত ২০ জন আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গতকাল রাত থেকেই এ এলাকাটিতে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সকালে ভোট শুরুর পর থেকে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনার পাশাপাশি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একটি মোটরসাইকেল। পুলিশ সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলবে। সবকটি কেন্দ্রে এবারই প্রথমবার ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন। ভোটার প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ। মেয়র পদের জন্য সাতজনসহ মোট প্রার্থী ২৩২ জন। তবে একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় নগরীর ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে আজ ভোট হচ্ছে না। এই ওয়ার্ডে মেয়র ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট নেয়া হবে।

ভোটকে কেন্দ্র করে সোমবার মধ্যরাত থেকে প্রার্থীরা তাদের টানা দুই সপ্তাহের নির্বাচনি প্রচারণা শেষ করেছেন। ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় নয় হাজার পুলিশ-আনসারের পাশাপাশি মোতায়েন রয়েছে ২৫ প্লাটুন বিজিবি, ২৫ প্লাটুন র‍্যাব, স্ট্রাইকিং ফোর্সসহ মোট ১৮ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এছাড়া যে কোনো ধরনের অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচারের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় আছেন ২০ জন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট।

আওয়ামী লীগ মনোনীত এম রেজাউল করিম চৌধুরী (নৌকা), বিএনপি মনোনীত ডা. শাহাদাত হোসেন (ধানের শীষ), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মাওলানা এমএ মতিন (মোমবাতি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আবুল মনজুর (আম), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী (হাতি)।

নির্বাচনে ১৪ সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রার্থী রয়েছেন ৫৭ জন। সাধারণ ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩৯ ওয়ার্ডে। ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। আর ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিম মৃত্যুবরণ করায় ওই পদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। তবে ওই ওয়ার্ডে মেয়র ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোটগ্রহণ হবে। ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী হোসেন মুরাদ ইন্তেকাল করলে সেখানে আবদুল মান্নানকে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ৩৯ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ১৬৮ প্রার্থী।

সংঘাত-সংশয়ে নির্বাচন, ঘোষণাতেই সার সিএমপি : সংঘাতের মধ্য দিয়ে চলছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। শুরুতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। ঝরেছে প্রাণ। সকাল থেকেই অনেক কেন্দ্রই ফাঁকা। কোথাও কোথাও দেখা মিলেছে লাঠি হাতে ঘুরছে কিশোররা। তাদের বেশিরভাগই বহিরাগত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

অথচ ভোটের দিন বহিরাগত ঠেকাতে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকেই অবস্থান ও প্রবেশ করতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল নগর পুলিশ (সিএমপি)। কেন্দ্রে কেন্দ্রে বহিরাগতরা নিবির্ঘ্নে ঘুরে বেড়িয়ে সংঘাতে জড়ালেও পুলিশ যেন নির্বিকার।

নগরের খুলশী থানার আমবাগানে বুধবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল ১০টার দিকে নির্বাচনী সহিংসতায় একজন নিহতের ঘটনার পর পুলিশ অবশ্য কিছুটা কঠোর অবস্থানে গেছে। তবে যেসব এলাকায় সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি সেগুলোতে কেন্দ্রের বাইরে সরকার দলীয় কর্মীদের জটলা। কেন্দ্রে ভোটারদের ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ।

অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর এজেন্টদের অনেক কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

এর আগে নগরের লালখান বাজারে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল হাসনাত বেলাল ও দলটির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী এফআই কবির মানিকের সমর্থকদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।

যদিও লালখান বাজারে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করতে গিয়ে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেছেন, ‘আমরা শুরু থেকে কঠোর অবস্থানে ছিলাম। এরপরও কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আমাদের স্ট্রাইকিং ফোর্সের পাশাপাশি রিজার্ভ ফোর্সও মাঠে নামিয়ে দিয়েছি। হত্যাসহ নির্বাচনী সহিংসতায় যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এখন পর্যন্ত যা হওয়ার হয়েছে পরের সময়ে ভোট যাতে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদে হতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

এর আগে মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের দিন সরকারি কর্মদিবস রয়েছে। অনেকে কর্মস্থলে যাবেন। তাদেরও জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার জন্য বলা হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে যারা আসবেন তারাও জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে আসবেন। আমরা বহিরাগত ঠেকাতে চাই। জানিয়ে দিতে চাই— যাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে, তাদের জন্য উৎসবমুখর হবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কিন্তু যাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে না তাদের জন্য মানে বহিরাগতদের জন্য দ্বার বন্ধ। কোনো বহিরাগত এসে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।’

সিএমপির এই সিদ্ধান্তে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বহিরাগত ঠেকানোর একটা পথ হচ্ছে এনআইডি কার্ড। একজন ভোটারকে শনাক্ত করা যাবে তার এনআইডি কার্ডের মাধ্যমে। এই কার্ড যার কাছে থাকবে তিনি এখানকার সম্মানিত ভোটার। তবে বয়স্ক নারী কিংবা বৃদ্ধ লোককে আমরা এ জন্য আটকাবো না। আপনারা জানেন নির্বাচনে সাধারণত কারা শক্তি প্রদর্শন করে থাকে, তাদের জন্য এ বার্তা।’

উল্লেখ্য, পঞ্চম নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষের আগে গত বছরের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত সবই সম্পন্ন হয়। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মাত্র কয়েক দিন আগে স্থগিত করা হয় নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রে বুথ চার হাজার ৮৮৬টি। মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন এবং মহিলা ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন। ভোট গ্রহণের দায়িত্বে আছেন ১৬ হাজার ১৬৩ জন কর্মকর্তা। সবাইকে ইভিএম বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এর মধ্যে রয়েছেন প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা পাঁচ হাজার ৯০২ জন এবং পোলিং কর্মকর্তা ১০ হাজার ২৬৮ জন।

চসিক নির্বাচনে এবার প্রথমবারের মতো সব কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। ভোটের জন্য প্রস্তুত ১১ হাজার ৫৭২ ইভিএম। চার হাজার ৮৮৯টি বুথের জন্য একটি করে ইভিএম। এ ছাড়া দুটি কক্ষের জন্য একটি করে ইভিএম অতিরিক্ত আছে। আর ঝুঁকি এড়ানোর জন্য বিশেষ ব্যাকআপও রাখা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই