ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নানা পরিকল্পনা আঁটছে বিএনপি। সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কি হবে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে বাধ্য করতে এমন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। তারা এখন কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট সরকারে পরিণত হয়েছে। দেশের স্বার্থেই এখন তাদের বিদায় নিতে হবে।’
ইতোমধ্যেই জনস্বার্থ নিয়ে রাজপথে সভা-সমাবেশ শুরু করেছে দলটি। একসঙ্গে আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সংলাপও শেষ করেছে তারা। আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামে। শিগগিরই এ ব্যাপারে ঘোষণা আসবে এবং সরকার গঠন ও রাষ্ট্রসংস্কারের জন্য কৌশল প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিও এই পরিকল্পনার অংশ, যা তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে দৃশ্যমান।
এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই সংসদ বাতিল করতে হবে এবং একটা নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, যাদের নেতৃত্বে নতুন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। তারা সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সকল ভোটার যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এটাই আমাদের প্রধান বিষয়।’
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এরপর তাদের সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এই দুটি নির্বাচনে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত দিতে পারেনি বলে বিএনপির দাবি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় তারা। বিএনপি বলছে, ২০১৪ সালে ১৫৪ আসনের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। আর ২০১৮ সালে জনগণ ভোটই দিতে পারেনি। নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়ে যায় বলে বিএনপির অভিযোগ।
দলীয় সরকারের অধীনে এমন অভিজ্ঞতার নজির তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এই জন্যই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আগেও সংশোধন করেই সংবিধানে এই সরকারের বিধান সংযোজিত করা হয়েছিল। বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজন করতে এটাই তাদের সুযোগ।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না। আর কোনো নির্বাচনও করতে দেওয়া হবে না।’
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ডান-বামসহ সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে সংলাপ করেছে বিএনপি। এরই মধ্যে ২০ দলীয় জোটের শরিকদলসহ ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে তারা। উদ্দেশ্য এক দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন করা। সোমবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে পরদিন মঙ্গলবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে যুগপৎ আন্দোলনের আহবানও জানান।
তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রেক্ষিতে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অতিদ্রুত এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা আপনাদের সামনে, জাতির সামনে আসব।’
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সঙ্গে আন্দোলনের বিষয়ে সংলাপ করবেন কিনা প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘জাতীয় পার্টির সঙ্গে এখনো আমরা ফরমালি কোনো আলাপ-আলোচনা করিনি।’
তবে তিনি আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পথে সব দলের জন্যই দরজা খোলা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রাস্তা খোলা। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, যেকোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠন যারা এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করবে, তাদের নিয়ে আমরা যুগপৎ আন্দোলন করব।’
নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করলে রাষ্ট্রসংস্কারের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। এ সংস্কার বিএনপি একা করতে চায় না। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও ব্যক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে বলে এর আগেই লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন যে, নির্বাচনের পরে আন্দোলনকারী যেসব দল থাকবে তাদের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।’
এর প্রধান কারণ হিসেবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে সেগুলোর মেরামতের কাজ এককভাবে করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। সেই কারণে অন্যান্য দলকে যুক্ত করতে চাই। তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পার্লামেন্ট, মিডিয়া- এসবের ক্ষেত্রে যেন আমরা সুস্পষ্টভাবে সকলের সর্বসম্মতিক্রমে না হলেও কনসেনসাসের ভিত্তিতে যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারি সেজন্য আমরা জাতীয় সরকারের চিন্তা করেছি।’
এছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে লবিং করছে বিএনপি। দলটির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপকমিটি এ কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত উপকমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব মুশফিকুল ফজল আনসারী সেখানকার হোহাইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে নিয়মিত হাজির হন এবং বাংলাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, যা মাঝেমধ্যে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
সম্প্রতি ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকশন এক টুইট বার্তায় বলেন, তার সঙ্গে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল দেখা করেছে। তারা দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, ‘সারাদেশে বিএনপির চলমান আন্দালনে যে তিনজন মারা গেছেন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হাই কমিকমিশনার।’ অন্যদিকে কদিন আগে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেটের কাছেও সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে দলিলপত্র হ্স্তান্তর করেছে দলটি। এরপর জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাচলেট বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানান এ ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিটি গঠন করতে, যেখানে জাতিসংঘ সহায়তা করবে।
বিএনপি গত ২২ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর অবধি সারাদেশে সভা-সমাবেশ করেছে। ১১ আগস্ট থেকে ঢাকা মহানগরীর দুই কমিটির উদ্যোগে ১৬টি স্পটে সভা-সমাবেশের কর্মসূচি চলছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এমন ধরনের কর্মসূচি আরও আসবে।’
সোনালীনিউজ/এম