‘অগ্নিকন্যার’ বিবর্ণ শেষ বিদায়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০৭:৩৬ পিএম

ঢাকা : ভিন্ন এক বাস্তবতায় বর্ণহীন আনুষ্ঠানিকতায় শেষ বিদায় নিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস যাকে মনে রাখবে ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে।

দুই দফা জানাজা শেষে বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে মতিয়া চৌধুরীকে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্বামী বজলুর রহমানের কবরে শয়িত করা হয়।

তবে দাফনের আগে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর কোনো আয়োজন ছিল না। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় জানাজায় অংশ নেওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। দলের শীর্ষ নেতাদের কাউকে জানাজায় দেখা যায়নি।

বুধবার ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

বৃহস্পতিবার সকালে তার মরদেহ রমনায় তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হলে ভক্ত, অনুসারী ও স্বজনরা সেখানে ভিড় করেন।

সেখানে জানাজার আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয় দলের এই জ্যেষ্ঠ নেতার প্রতি।

দুপুরে জোহরের নামাজ শেষে গুলশানের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে (আজাদ মসজিদ) আরেক দফা জানাজা হয় মতিয়া চৌধুরীর। নামাজ শেষে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান আতা, সাবেক ছাত্র নেতা সৈয়দ আবু তোহা, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, সাবেক ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের উপ কমিটির সদস্য প্রকৌশলী গৌতম দাস, প্রকৌশলী মো. সঞ্জীব ইসলাম আফেন্দী, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বশিরুল আলম নিয়াজি, মোর্শেদুজ্জামান সেলিম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আনোয়ারুল আজীম সাদেক, কাজী শহীদুল্লাহ লিটন, আনোয়ার হোসেন টিংকু, তাওহিদুর রহমান, জহিরুল ইসলাম ইসহাক, তাহিদুর রহমান সেলিমসহ নেতাকর্মীরা জানাজায় অংশ নেন।

বনানী থানা আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, দৈনিক সংবাদ পরিবার, মণি সিংহ ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট, বিশেষ গেরিলা বাহিনীসহ পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রয়াত নেতার কফিনে।

সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এসেছিলেন মতিয়া চৌধুরীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

পরে মতিয়া চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে স্বামীর কবরে তাকে দাফন করা হয় বলে তার ভাই মাসুদুল ইসলাম চৌধুরী জানান।

শেরপুর-২ আসনের ছয়বারের সংসদ সদস্য মতিয়া চৌধুরী ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালে তাকে সংসদ উপনেতার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে মতিয়া চৌধুরীর জন্ম। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৬৪ সালে সাংবাদিক বজলুর রহমানের সঙ্গে মতিয়ার বিয়ে হয়।

ইডেন কলেজে পড়ার সময় বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে জড়ান মতিয়া চৌধুরী। ১৯৬১-৬২ মেয়াদে তিনি ছিলেন ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের ভিপি। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা ছিল মতিয়া চৌধুরীর। আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিঝরা বক্তৃতার জন্য তাকে বলা হত ‘অগ্নিকন্যা’।

১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন মতিয়া। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠনে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে মতিয়া যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৮৬ সালে দলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এক সময় তাকে দলের নীতি নির্ধারণী পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে মতিয়া চৌধুরীকে। জেলজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি।

রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে সারাজীবনই সাধারণ বেশভূষা আর সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য পরিচিত ছিলেন মতিয়া চৌধুরী।

সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়।

তবে বিদায় বেলায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও মতিয়ার ক্ষেত্রে তা হয়নি।

জানতে চাইলে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহীন হোসেন প্রিন্স বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-সিপিবিসহ গেরিলা বাহিনীর

যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে ২৩ শর মত তালিকা ভুক্ত হয়েছেন। সেখানে মতিয়া চৌধুরী তো নেতৃত্বে ছিলেন।

মতিয়া চৌধুরীর ভাই মাসুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আপা তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে এসে প্রথমে গার্ড অব অনারের খুব তোড়জোড় দেখলাম, পরে আর কেউ আসেনি। আমরা যোগাযোগ করার পরে বলল উনার নাম তো পিরোজপুরে, তার পরে আর কেউ এল না।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দারুস সালাম থানার ওসি রাকির-উল-হোসেন বলেন, আমরা তো গতকালও একজনকে গার্ড অব অনার দিয়েছি। আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে তো অবশ্যই দিই। উনার বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করেনি।

এমটিআই