এ দুদর্শার দায় কার?

মালয়েশিয়ায় গিয়ে বেকার বাংলাদেশি কর্মীরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৪, ১১:২৬ এএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা : চার বছর বিরতির পর ২০২২ সালের আগস্টে শ্রমবাজার পুনরায় চালু করার পর মালয়েশিয়া সৌদি আরবের পরে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিয়োগদাতা দেশে পরিণত হয়েছে।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে ঝিনাইদহের ২০ বছর বয়সি সুমন হোসেন একটি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু যাওয়ার পর সেখানে বেকারত্বের মুখে পড়েন এ তরুণ।

তার মা সায়রা বানু ছেলের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে সহায়তা চেয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

তার কোনো কাজের ব্যবস্থা, এমনকি খাবারের ব্যবস্থাও করেনি। বর্তমানে নির্দিষ্ট জায়গার বদলে তাকে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে দিচ্ছে, অভিযোগপত্রে বলেন সায়রা বানু।

রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে গিয়ে কোনো সমাধান তো পাননি, বরং খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

২০২২ সালের আগস্টে মালয়েশিয়া নিজেদের শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার পর থেকে দেশটিতে যাওয়া প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বেকারত্ব ও শোষণের মুখে পড়েছেন।

[215333]

বিএমইটির কর্মসংস্থান বিভাগের একটি সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের কাছ থেকে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ ধরনের অভিযোগের হার দ্রুত বেড়েছে।

আগে প্রায় ৮৫ শতাংশ অভিযোগ আসত সৌদি আরব থেকে। কিন্তু এখন আমরা মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব দুই দেশ থেকেই সমানে-সমানে অভিযোগ পাচ্ছি, বলেন ওই সূত্র।

অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা নিয়োগকর্তা, দালাল ও নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচ্চ বেতনের চাকরির মিথ্যে প্রতিশ্রুতি এবং কৃত্রিমভাবে খরচ বাড়িয়ে মরিয়া কর্মীদের ফাঁদে ফেলার জটিল একটি পরিস্থিতিকে দায়ী করেছেন।

মালয়েশিয়ায় অভিবাসন খরচ সরকারিভাবে ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মতে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরকে।

অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে বেকারত্বের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়োগকারী সংস্থাগুলো বলছে, তাদের ভূমিকা বিদেশি নিয়োগদাতাদের চাহিদার ভিত্তিতে কর্মী বাছাই করে পাঠানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এসব সংস্থার যুক্তি হলো, যদি নিয়োগের চিঠি ভুয়া হয়, তাহলে তার জন্য মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা উচিত।

বিএমইটির ইমিগ্রেশন পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, চাকরি সংক্রান্ত অভিযোগ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আমরা সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছি। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় যেসব কোম্পানিতে বাংলাদেশিরা কাজ পাননি, তাদেরকে মালয়েশিয়ান সরকার কালোতালিকাভুক্ত করেছে। সে অনুযায়ী আমরা এখানে পদক্ষেপ নিচ্ছি যাতে নতুন করে এসব কোম্পানিতে আমাদের কর্মীরা না যান।

কোনো সিন্ডিকেট আছে?

বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকার কর্মী নিয়োগের জন্য বাংলাদেশের আড়াই হাজার রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মাত্র ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে বেছে নেয়। এতে একটি তথাকথিত 'সিন্ডিকেট' তৈরি হয়েছে।

এ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই বাছাইকৃত এজেন্সিগুলোও আরও ১০টি পর্যন্ত এজেন্সির সঙ্গে অংশীদারিত্ব শুরু করতে পারে। এতে সুযোগ বাড়লেও দায়িত্বের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।

চার বছর বিরতির পর ২০২২ সালের আগস্টে শ্রমবাজার পুনরায় চালু করার পর মালয়েশিয়া সৌদি আরবের পরে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিয়োগদাতা দেশে পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি ২০২২ সালের আগস্টের পর থেকে উৎপাদন, নির্মাণ, সেবা, বৃক্ষরোপণ, কৃষি, খনি এবং এমনকি গৃহস্থালী পরিষেবার মতো বিভিন্ন খাতে চার লাখ এক হাজার কর্মী নিয়োগ করেছে।

এগুলোর মধ্যে নির্মাণ খাত প্রতারণামূলক নিয়োগের কেন্দ্রস্থল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে — খাতসংশ্লিষ্টরা অনেকেই এ খাতের বিভিন্ন বিপজ্জনক দিক তুলে ধরেছেন।

কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো

তথাকথিত সিন্ডিকেটের এজেন্সিগুলো বলেছে, তারা কেবল যাচাই-বাছাই বা প্রসেস করে শ্রমিকদের পাঠায়। এ সংকটের জন্য মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারাই দায়ী।

সিন্ডিকেটের সদস্য সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় সফলভাবে দুই হাজার ২০০ কর্মী প্রেরণ করেছে। তবে এই এজেন্সি ব্যবহার করে যাওয়া অনেক কর্মী অভিযোগ করেছেন, তারা মালয়েশিয়ায় পৌঁছে কোনো চাকরি পাননি।

সাদিয়া ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন: আমরা বেশিরভাগ [কর্মী] নির্মাণ খাতে পাঠিয়েছি। এছাড়া সেবা খাতেও অনেকে গেছেন। যেহেতু নির্মাণ খাতে বেশি গেছেন, সেখানে বেশি সমস্যা হয়েছে। আমাদের যারা গেছেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই [চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে] বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কত শতাংশ কর্মী বেকারত্বের সমস্যায় পড়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, একেবারে সঠিক সংখ্যাটা বলা খুব কঠিন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি কর্মসংস্থানের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে অনেককে আবার পুনরায় নিয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)-এর সাবেক এই মহাসচিব আরও বলেন, দুই দেশের সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর আমাদের কর্মীরা বিদেশ যান। চাকরির চিঠি দূতাবাস যাচাই-বাছাই করে। তাহলে কেন হাজার হাজার মানুষ বিদেশে যাওয়ার পর চাকরি পাচ্ছেন না?

কেন বাংলাদেশি এজেন্সিগুলো এর জন্য দায়ী হবে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সেবা প্রদানকারী। [মালয়েশিয়ার] নিয়োগকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা প্রসেস করে কর্মী পাঠাই।

নিয়োগকর্তাদেরকে মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে বলেই তারা যেতে পেরেছেন। কর্মীরা এখন চাকরি না পেলে নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের কর্তৃপক্ষের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

বিদেশি শ্রমিক বেড়েছে মালয়েশিয়ায়

মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি বিদেশি শ্রমিকদের অতিরিক্ত প্রবাহ নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসুশন গত অক্টোবরে বলেছেন, বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিষয়ে নিয়ম শিথিল ও পরিবর্তনের ফলে দেশটির উৎপাদন ও সেবা খাতে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়ে আড়াই লাখ ছুঁয়েছে।

তিনি বলেন, ৯ অক্টোবর পর্যন্ত মালয়েশিয়া মোট ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৪১৮ জন বিদেশি কর্মী গিয়েছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়া শিথিল ও পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ সংখ্যা পাঁচ লাখ ১৮ হাজার হতে পারে বলে আগে ধারণা করা হয়েছিল।

মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর এ মন্তব্যের প্রসঙ্গে কুয়ালালামপুরভিত্তিক অভিবাসী শ্রমিক অধিকার বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি হল টেলিফোনে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী আমি বলব অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি বেকার হয়ে পড়েছেন। কারণ বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত করার পর মোট নিয়োগের প্রায় ৬০ শতাংশ হয়েছে দেশটি থেকে।

যত কর্মী, তত টাকা!

মালয়েশিয়ায় কয়েক মাস ধরে বেকার বসে থাকা বাংলাদেশিসহ কয়েকশ দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী গত বছরের মে মাসে রয়টার্সকে বলেন, হাজার হাজার ডলার ফির বিনিময়ে রিক্রুটিং এজেন্টদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ায় তারা এখন আশা হারিয়ে ফেলছেন।

তারা জানান, তারা তিন মাসের ওয়ার্ক ভিসায় মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। এ ভিসা পরে ওয়ার্ক পারমিটে পরিণত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা কখনোই হয়নি। ফলে দেশটিতে তাদের আইনি অবস্থা অস্পষ্ট হওয়ায় তারা এখন ঘর ছেড়ে বেরোতেও ভয় পান বলে রয়টার্সকে জানান একটি ফ্যাসিলিটিতে থাকা শ্রমিকেরা।

ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অভ প্রাইভেট এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সিস মালয়েশিয়া (প্যাপসমা)-এর সেক্রেটারি-জেনারেল সুকুমারন নায়ার দেশটির গণমাধ্যম ফ্রি মালয়েশিয়া টুডেকে গত ২৬ ডিসেম্বর বলেন, মূলত নিয়োগ ফি ২৫ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত-ই এজেন্টদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদেশি কর্মী আনার আবেদনের মূল কারণ।

তিনি আরও বলেন, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা এ সংস্থাগুলো রক্তচোষা। প্রতিজন কর্মী নিয়োগ ফি বাবদ ২০ থেকে ২৫ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত প্রদান করেন। তাহলে ভাবুন কোম্পানিগুলো কী পরিমাণ মুনাফা করছে।

এ কারণেই বাংলাদেশের এজেন্টরা সেখান থেকে যতসংখ্যক সম্ভব কর্মী আনার চেষ্টা করে।

সুকুমারন জানান, পরিস্থিতি এমনও ছিল যে কোনো কোম্পানির হয়তো কেবল ১০ জন বিদেশি কর্মী দরকার, কিন্তু নিয়োগকারী সংস্থার এজেন্ট ১০০ জনের জন্য আবেদন করে বসে আছেন।

এমটিআই