‘বউ-বাচ্চা পুইড়া গেছে, বের হয়ে কী করব’

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৪, ০৮:৩৪ এএম

ঢাকা: রাজধানীর গোলাপবাগে ট্রেনে আগুনের মধ্যে জানলায় শরীরের একাংশ বাইরে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য ছুঁয়ে গেছে মানুষকে। সেই ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু তার স্ত্রী ও সন্তান পুড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বের হয়ে কী হবে?’

শুক্রবার (৪ জানুয়ারি) রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি তার গন্তব্যস্থল কমলাপুর পৌঁছার কিলোমিটার দুয়েক আগে থেমে যেতে বাধ্য হয়। ট্রেনটির তিনটি বগি পুড়ে যায়।

বগি তিনটি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে তিনজনই একই পরিবারের, যারা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান। পরিবারটির এমন পরিণতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা। তিনি আগুন লাগার পর উদ্ধার কাজেও অংশ নেন।

তিনি বলেন, ‘‘আমার বাসা রেললাইনের পূর্ব পাশে। ঘুমাইতে ছিলাম। ফোন দিয়ে একজন খবর দিছে আগুন লাগছে বেনাপোল এক্সপ্রেসে। খবর শুইন্যা বের হই। তখন দেখি ‘চ’ বগির এক লোক জানালায় আটকে ছিল। আমি তারে ধরে বের করতে চাইছিলাম।’’

মাসুদ বলেন, ‘‘তার (জানলায় থাকা সেই ব্যক্তি) ঘাড়ের উপর জানালা নেমেছিল। জানালা ভেঙে তাকে বের করার চেষ্টা করছিল। তখন ওই ব্যক্তি বললেন, ‘আমার বাচ্চা ও বউ অলরেডি পুইড়া গেছে। আমারও ৯০ পারসেন্ট পুইড়া গেছে। আমি আর বের হয়েই বা কী করব। থাইকাই বা কী লাভ?’’

ততক্ষণে বগিটির বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গিয়েছিল। আগুনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছিল উত্তাপ। এক সময় উদ্ধারের চেষ্টায় থাকা মানুষদেরকে সরে আসতে হয় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে।

মাসুদ রানা তিনি বলেন, ‘‘গরমে ট্রেনের কিছুই ধরা যাচ্ছিল না। তারে টাইনা নামানোর চেষ্টা করছি, বের করতে পারি নাই।’’জানালায় আটকে থাকা অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করার একাধিক ভিডিও করেছেন পথচারীরা। তাতে দেখা যায়, ট্রেনের বগির নিচের অংশে ভর করে জানালা ধরে পুড়তে থাকা ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন অনেকে। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

[214671]

মাসুদ রানা বলেন, “স্থানীয় মানুষ পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আগুন এত বড় ছিল যে হাতে পানি দিয়ে তা নেভানো সম্ভব ছিল না।” পরে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেও ততক্ষণে নাম না জানা সেই ব্যক্তি ও তার স্ত্রী-সন্তানের জীবন প্রদীপও নিভে যায়।

কুষ্টিয়ার দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে সপরিবারে ঢাকায় আসছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। আগামী ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল তার। তবে এই যাত্রা আর হচ্ছে না। কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আগুনে আমার পাসপোর্ট, টিকিট ও লাগেজ পুইড়ে গেছে। কিছুই বাঁচাতে পারিনি।’’

বিদেশ যাত্রা বাতিল হলেও পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছেন, এটাই শান্ত্বনা আশরাফুলের মতো। তারা ছিলেন বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘ছ’ বগিতে। দুবাই যাবেন বলে সপরিবারে ঢাকায় আসছিলেন কুষ্টিয়ার মোহাম্মদ আশরাফুল। সব কিছু পুড়ে গেলেও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদে বের হতে পেরেছেন তিনি। আশরাফুল বলেন, “ধোঁয়ায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। আমার ছোট বাইচ্চাডাকে জানালা দিয়ে কোনোরকম ফেলে দিয়েছিলাম। নিচে এক লোক ‘ক্যাচ’ ধরার মতো ধইরে ফেলায় বেঁচে গিয়েছে।

‘‘পরে আমার স্ত্রী ও আরেক ছেলে অনেক কষ্ট করে বের হইয়েছে। আমি জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আগুনে আমাদের কোনো ক্ষতি হইনি।’’আগুন লাগার পর পর কী হয়েছে তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎ এক পুলিশ বলছে ‘চেইন টানেন, চেইন টানেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে?’ ওই পুলিশ বলল, ‘ভাই আগুন লাগছে।’

“বলতে বলতে আমি ঘুরে আর কিছুই দেখতে পারছিনা, ধোঁয়া আর ধোঁয়া-এতো কালো ধোঁয়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।’’

এআর