ঢাকা : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের শিক্ষাজীবনের সব শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত। আকিদা, আখলাক ও ইবাদত বিষয়ে ইসলাম যেমন আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করে তেমনি অর্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও পথ দেখায়। ইসলাম অর্থব্যবস্থাপনায় এমন সব নীতিমালা উপহার দিয়েছে, যেগুলো ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও আবিষ্কারের এই আধুনিক যুগেও সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। আফসোসের বিষয় হলো, দীর্ঘকাল যাবৎ পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামী বিশ্বের ওপর এমন অর্থব্যবস্থা চাপিয়ে রেখেছে; যেগুলোর মূলভিত্তি সুদ, জুয়া, প্রতারণাসহ অসংখ্য খারাবির ওপর। যেগুলো ইসলামী অর্থবিজ্ঞানের পরিপূর্ণ বিপরীত এবং সরাসরি মানবতাবিরোধী।
দীর্ঘ সময় যাবৎ সুদি অর্থব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার পর ইসলামী বিশ্ব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ইসলামী পন্থায় পরিচালিত করার জন্য মূলনীতি তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। এ প্রচেষ্টার সর্বপ্রথম সফলতা হলো ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। স্বল্পসংখ্যক উদ্যোক্তার উদ্যোগে ১৯৭৬ সালের পূর্বেই সুবিহীন অর্থব্যবস্থার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে বড় পরিসরে ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হয়। আল্লাহর রহমতে বর্তমানে সারা বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যেগুলোতে ইসলামী নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। কিছু ব্যাংক পরিপূর্ণ ইসলামী বিধান মতে কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর কিছু আছে, যেগুলো মূলত সুদি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ইসলামী ব্যাংকিং নীতি অনুসরণ করে।
ইসলামী ব্যাংকিং কতটুকু ফলদায়ক? ইসলামী ব্যাংকসমূহের দুর্বলতা কতটুকু? এর সীমাবদ্ধতা বা প্রয়োজনীয়তা কী কী? এই প্রশ্নোগুলোর উত্তর জানার পূর্বে ইসলামী ব্যাংক এবং প্রচলিত ব্যাংকের মাঝে প্রধানতম পার্থক্য কী, সেটা জানা প্রয়োজন। সংক্ষেপে বললে, ব্যাংকের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ আবশ্যক। পুঁজির ওপরেই ব্যাংকের স্থায়িত্ব ও উন্নতি নির্ভরশীল। ইসলাম ক্যারেন্সি বা টাকাকেই মূল ব্যবসায়ী পণ্য নির্ধারণ করে অন্যান্য পণ্যের মতো লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়কে নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এটাই সুদ। মুদারাবা, কিস্তি, সলম, ইজারা, শিরকত ইত্যাদি ব্যবসা পদ্ধতিগুলো এমন, যেগুলোতে বাস্তব আদান-প্রদানের অনুগামী হয়ে ক্যারেন্সির ব্যবসা হয়। সুতরাং, ইসলামী ব্যাংকে জমাকৃত পুঁজি থেকে সরাসরি তার মালিক লাভ পাওয়ার সম্ভবনা নেই, যতক্ষণ না তার পুঁজি উল্লিখিত ব্যবসা পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হবে। সুদি ব্যাংকে এর উল্টো চিত্র। সুদি ব্যাংকে সরাসরি ক্যারেন্সির বিনিময়ে ক্যারেন্সি লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হয়; বরং বাস্তবতা হলো, এটিই সুদি ব্যাংকের মূল বিজনেস। এদিকে মোটেও ভ্রূক্ষেপ করা হয় না যে, পুঁজিকে সরাসরি উপরিউক্ত পদ্ধতিতে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না?
ইসলামী ব্যাংকের অস্তিত্ব আনুমানিক ৪৫ বছর হতে চলল। ব্যাংকিং সেক্টরের মতো বিশাল সেক্টরে ৪৫ বছর যথেষ্ট সময় না। ইসলামী ব্যাংকিং উপকারী কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরের জন্য উক্ত সময় যথেষ্ট না হলেও বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা বলছে, ইসলামী ব্যাংকিং অত্যন্ত উপকারী ও লাভজনক। ব্যাংকিং সেক্টরের সফল ভবিষ্যত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ভেতরেই। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা সুদি ব্যাংকব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প অর্থব্যবস্থা। মুসলমানদেরকে সুদের মতো জঘন্য গোনাহ থেকে বের হওয়ার পথ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা। পুরো অর্থব্যবস্থাকে ইসলামী পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার জোয়ার সৃষ্টি করেছে।
ইসলামী ব্যাংকিং বিধিমালা অনুযায়ী কৃষি, ব্যবসা ইত্যাদি করে লাভ-ক্ষতির সঠিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী-দ্বিতীয়পক্ষ উভয়ে সুদি ব্যাংকের চেয়েও বেশি মুনাফা অর্জন করছে। অভিজ্ঞদের বক্তব্য, ইসলামী ব্যাংক স্বল্প সময়ে যতটা উন্নতি-অগ্রগতি দেখিয়েছে সুদি ব্যাংক একই সময়ে তার কিছু অংশও দেখাতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এটাও সত্য, ইসলামী ব্যাংক সেক্টরে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা রয়েছে। এগুলোর উত্তরণ ঘটলে ইসলামী ব্যাংকিং আরো বেশি ফলদায়ক হবে। উদাহরণ স্বরূপ, কোন সেক্টরে এবং কোন পদ্ধতিতে পুঁজি বিনিয়োগ করা হবে? এর উত্তরে একটি স্থায়ী ও কার্যকর আধুনিক নীতি প্রণয়ন হয়নি। ফলে কৃষি ও অন্যান্য উৎপাদনশীল সেক্টরে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংক করার সক্ষমতা রাখে, মূলনীতি না থাকার কারণে সেটা করতে পারছে না। যার ফলে ইসলামী বিশ্ব ও মুসলিম দেশে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ সেক্টরে অন্য পদ্ধতির সাহায্য নিতে হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মানব উন্নয়ন শাখাসহ অন্যান্য অনেক উপকারী শাখায় বিভিন্ন অদৃশ্য কারণে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না।
ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি দিলে দুটি কারণ দৃষ্টিগোচর হয়। এক. ইসলামী ও ইনসাফি অর্থব্যবস্থা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিকট থেকে যতটুকু গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা কামনা করে তা পায় না। দুই. ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনার মতো দক্ষ, অভিজ্ঞ লোকের অভাব। এখন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সবচে বেশি প্রয়োজন এমন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব, যেখানে প্রচলিত অর্থব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থব্যবস্থার পরিপূর্ণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। এই প্রয়োজন পূর্ণ করার লক্ষ্যে মালয়েশিয়া, সুদান, বাহরাইন, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ ব্যাপক কার্যক্রম চালু করেছে। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি উভয়ভাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের এই দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে মুসলিম সংগঠন ও সংস্থা, ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উচ্চতর মাদরাসাগুলোতে এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
পশ্চিমা বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্যে ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রচলিত কিছু সুদি ব্যাংক শাখাগত কয়েকটি ইসলামী পদ্ধতি চালু রেখেছে। তাদের উদ্দেশ্য কখনোই এই নয় যে, তারা ইসলামী বিধি-বিধান মতে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়ন করতে চায়। তাহলে তাদের উদ্দেশ্য কী? ইসলামী অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নিচের তিনটির সবগুলো বা যে কোনো একটি তাদের টার্গেট। এক. ইসলামী বিশ্ব, মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের বিপুল পরিমাণ অর্থ-পুঁজিকে নিজেদের আয়ত্তে এনে বিশাল আর্থিক মুনাফা অর্জন। দুই. তারা ব্যাংকিংপদ্ধতি সম্পর্কে সবচে অভিজ্ঞ। তারা এ কথাও ভালোভাবে জানে যে, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কার্যকারিতা অন্য পদ্ধতির চেয়ে বেশি উপকারী, কার্যকরী ও লাভজনক। তিন. ইসলামী বিশ্বের পুঁজি নিজের কব্জায় নিয়ে সত্যিকার ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। যাতে ইসলামী ব্যাংকিং চেষ্টা পরিত্যাগ করে মুসলমানরা সুদি পদ্ধতিতে ফিরে যায়।
মোটকথা, উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সুদি ধারায় পরিচালিত ব্যাংকে ইসলামী শাখা অত্যন্ত জোরালোভাবে শুরু হয়েছে ও হচ্ছে। তাদেরকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা আমাদের সাজে না, আমাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। কারণ, ইসলামী নিয়ম ও পদ্ধতি পৃথিবীর সব দেশের সবার জন্য। যার উপকার হয়, সে প্রয়োগ করতে পারে। চিন্তার বিষয় হলো, যার উদ্দেশ্য খারাপ তার ক্ষতি থেকে আমরা কীভাবে আত্মরক্ষা করব? আমাদের করণীয় কী? আমাদের দায়িত্ব হলো, সুদি ও ইসলামী ব্যাংকের নীতিমালার ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা, তারা ইসলামী নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করছে কি না? যদি না করে তাহলে মানুষদেরকে জানিয়ে দেওয়া যে, অমুক ব্যাংক নিজেকে ইসলামী ব্যাংক হিসেবে ঘোষণা করে, বাস্তবে তার দাবি সঠিক নয়। তার কারণগুলোও বর্ণনা করে দিতে হবে। সুদি ব্যাংকের ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার এটিই কার্যকরী পদ্ধতি। যে নিজেকে প্রকাশ্যে এক ধরনের দাবি করে অথচ তার ভেতরে থাকে ভিন্ন রকম, তার ক্ষতির সম্মুখীন সবাইকে হতে হয়।
লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক