ঢাকা : ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেখানে মানবসমাজের সব কিছুই গোছালো, পরিপাটি ও সুবিন্যস্ত। মানবজাতির কল্যাণ সাধিত হয়। মানবসমাজে সভ্যতা সুদৃঢ হয়। অকল্যাণ আর অরাজকতা দূর হয়ে যায় এমন সব আদর্শ পদ্ধতি দিয়েই আল্লাহতায়ালা তাঁর ধর্ম ইসলাম মনোনীত করেছেন। খাওয়া-দাওয়া, চলন-বলন, থেকে শুরু করে মলমূত্র ত্যাগ করার পদ্ধতি পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ের জন্য পৃথক-পৃথক নিয়ম একমাত্র ইসলাম ধর্মই শিক্ষা দিয়েছে। ইসলামী জীবনবিধানে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে নিকাহ বা বিয়ে। বিয়ে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটি অধ্যায়। বিয়েকে সামাজিক বন্ধন বলা হলেও মূলত এটি একটি ঐশী বন্ধন। কারণ অজানা-অচেনা একজোড়া মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অতি অল্প সময়ে এতো বেশি আন্তরিক ও ভালোবাসাপূর্ণ সময় উপভোগ করতে পারে তা মহান আল্লাহতায়ালারই একান্ত অনুগ্রহ ও জান্নাতি ভালোবাসার মিশ্রণ ছাড়া অসম্ভব। বিবাহবন্ধনে রয়েছে স্রষ্টার সন্তুষ্টি, পাপ থেকে বেঁচে থাকা এবং মানবসভ্যতা রক্ষার এক অপূর্ব সমাধান।
ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মেও বিয়ের কথা উল্লেখ আছে। আছে নিজস্ব রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান। তবে ইসলাম ধর্ম বিবাহবন্ধনকে করেছে অনেক সহজ ও সুদৃঢ়। বাতলে দিয়েছে দাম্পত্য জীবনযাপনের নিয়মনীতি ও সুখী-সমৃদ্ধ পরিবারের রূপরেখা। এমনকী স্বল্প ব্যয়ের বিয়েকে হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে বলেছেন।
কিন্তু আজ আমরা ইসলামের আদর্শ ও মৌলিক শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে এসেছি। ফলে আজকের বিশ্বে শুধু অরাজকতা, অস্থিরতা, দুর্দশা ও হতাশা। আমরা আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা, তাহজিব-তামাদ্দুন থেকে দূরে সরে দিন দিন পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে ঝুঁকে পড়ছি! যদ্দরুন, আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শুধু অশান্তি আর অশান্তি। পশ্চিমা সভ্যতার নিয়মনীতি আজ আমাদের সমাজকে অক্টোপাসের ন্যায় ঘিরে রেখেছে। ঘৃণিত যৌতুকপ্রথাও এর অন্যতম অনুষঙ্গ। ইসলাম যৌতুককে কঠোরভাবে নিষেধ করে স্বামীকে স্ত্রীর মোহর আদায়ে উৎসাহিত করেছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের প্রাপ্য মোহর আদায় করে দাও।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৪) স্ত্রী হালাল করার জন্য ইসলামধর্ম স্বামীর মোহর আদায় করার কথা বলেছে।
মানবতার মুক্তির দূত হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অল্প বা বেশি মোহর ধার্য করে বিবাহ করে, কিন্তু মোহর পরিশোধ করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে ব্যভিচারী হিসেবে সাব্যস্ত করবেন।’ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হলো যে, মোহর দিয়ে বিবাহ করতে হবে। মেয়ে পক্ষ থেকে কোনো প্রকার যৌতুক নেওয়া বৈধ হবে না। বর্তমান সমাজে অভিশপ্ত যৌতুকের কারণে অসংখ্য পরিবার ধ্বংসের মুখে। সুখী পরিবারগুলোতে আজ অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। অভিশপ্ত যৌতুকের কারণে অনেক দুগ্ধপোষ্য শিশু এতিম হচ্ছে। অসংখ্য যুবক-যুবতী পশুত্বের জীবন বেছে নিয়েছে। ধ্বংস হচ্ছে সমাজের শৃংখলা। অসংখ্য নারী পতিতা, ভিখারিনী, চিরকুমারী এমনকী আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে অহরহ। যা পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়!
যৌতুকপ্রথায় বিধ্বস্ত সমাজে যৌতুকবিহীন বিয়ের কথা বর্তমানে কল্পনা করাটাও এক প্রকার অপরাধের মতো হয়ে গেছে। নগদ টাকা, মোটরসাইকেল, খাট-পালঙ, টিভি-ফ্রিজ থেকে শুরু করে টয়লেটের বদনা পর্যন্ত এখন যৌতুক হিসেবে নেওয়া হয়। আধুনিক সময়ে এসে যৌতুক চাওয়ার পদ্ধতিতেও কিছুটা নতুনত্ব এসেছে। সরাসরি বলার মুখ লজ্জায় অনেকে খালি ঘর দেখিয়ে কনে পক্ষকে বলে থাকেন, আপনার মেয়ে এই ঘরে থাকবেন। একজন পিতা দীর্ঘ ১৮ বছর আদরের মেয়েকে লালন-পালন করতে যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, মেয়েকে বিয়ে দেবার সময় তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি কষ্ট পান। অনেক পিতাকে দেখা যায়, গোয়ালের গরু থেকে শুরু করে জায়গা-জমি সব বিক্রি করে যৌতুক দিচ্ছেন। মোটকথা যৌতুকপ্রথা আমাদের জীবন ও সমাজকে অসহনীয় করে তুলছে।
জোরপূর্বক যৌতুক আদায় করার অর্থ হচ্ছে অন্যের সম্পদ তাঁর অনুমতি ব্যতীত জোর-জবরদস্তি করে ভোগ করার নামান্তর। আর আল্লাহতায়ালা কারো সম্পাদকে তাঁর অনুমতি ব্যতীত ভোগ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না এবং জনগণের কিয়দংশ জেনে-বুঝে পাপপন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশে শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিও না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৮) আল্লাহতায়ালা উক্ত আয়াতে হারামপন্থায় সম্পদ অর্জন এবং ভোগ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। যেভাবে অন্য আয়াতে হালালপন্থায় সম্পদ অর্জন এবং ভোগ করার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি! জমিনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তা থেকে তোমরা হালাল ও পবিত্র বস্তুসমূহ খাও আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেননা সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৬৮) অনুরূপভাবে সুরা নাহলে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তোমাদেরকে আল্লাহতায়ালা যে পবিত্র ও হালাল রুজি দান করেছেন, তা থেকে খাও এবং আল্লাহর নিয়ামতসমূহের শুকরিয়া আদায় করো। যদি তোমরা তাঁরই ইবাদতকারী হয়ে থাক।’ উপরিউক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহতায়ালা হালাল-হারাম সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার পরও যারা নির্লজ্জ ও নির্লিপ্ত হয়ে অন্যের সম্পদ ভোগের আশা করে তারা কপাল পোড়া আর বদ-নসিব ছাড়া কিছুই নয়।
তবে কনেপক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যদি কোনো কিছু দিতে চায় তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো নারীকে বিয়ের পূর্বে মোহরানা বা দান হিসেবে কিংবা অন্য কোনো প্রকারে পাত্রের পক্ষ হতে কিছু দেওয়া হলে তা ওই স্ত্রীর জন্যই। আর বিয়ের পরে যা কিছু দেওয়া হবে সেটা তার যাকে তা দেওয়া হয়েছে। আর বিয়ে উপলক্ষে কেউ নিজ কন্যা বা বোনকে কিছু দিলে সেটা অধিক সম্মানজনক। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২১২৯) আল্লাহর নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে উপলক্ষে একটি চাদর, খেজুরপাতা-ভর্তি চামড়ার একটি তোশক, আটা ভাঙানোর ২টা চাক্কি, পানির একটি মশক এবং ২টি মাটির কলসি উপহার দিয়েছিলেন। কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিবাহ উপলক্ষে বিবাহের মজলিসে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। সেই ভাষণে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং বৈবাহিক সম্পর্কের মাহাত্ম্য বিশেষভাবে তুলে ধরেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘ইজ্জত ও জালালের অধিকারী আল্লাহ ফাতিমার সঙ্গে আলিকে বিয়ে দিতে আমাকে হুকুম করেছেন। তোমরা সাক্ষ্য থাক যে, চারশ মিসকাল রুপার মোহর ধার্য করে বিয়ে সম্পাদন করেছি। অবশ্য যদি তা পরিশোধ করতে আলি রাজি থাকে।’ অতঃপর আলি (রা.) তা কবুল করেন এবং দোয়া পড়ার মাধ্যমে বিবাহ সমাপ্ত হয়।
যৌতুক বাংলাদেশের আইনেও নিষিদ্ধ : বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে আইন করে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর দুই দফায় সংশোধন করে কিছুদিন পূর্বে তা হালনাগাদ করে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ নামে নতুন আইন পাশ করা হয়। যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল-জরিমানাসহ শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে এর সাথে নির্যাতন জড়িত থাকলে তখনই শুধুমাত্র এই মামলা গুরুত্ব পায় এবং তা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন দিয়ে বিচার করা হয়ে। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে ২০১৮ সালে ১০২ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্যকে একটি আংশিক চিত্র বলে মনে করা হয়। কারণ, অনেক তথ্যই খবরের কাগজে প্রকাশ পায় না। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে ৬৭২৮ টি যৌতুকের মামলা হয়েছে। বাংলাদেশে আইনত যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া নিষিদ্ধ। ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনে যৌতুক একটা বড় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার সাথে সাথে বর্তমান দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কাছে যৌতুক তেমন কোনো অপরাধ হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। যার ফলে দিন দিন বেড়েই চলছে যৌতুকের ন্যায় বিষাক্ত সংস্কৃতি।
পরিশেষে একটি দাবি উত্থাপন করছি, জাতির কর্ণধার হজরত ওলামায়ে কেরাম যদি মসজিদের মেহরাব, ওয়াজের স্টেজ, টেলিভিশনের পর্দায়, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদি মাধ্যমে কুরআন-হাদিসের আলোকে যৌতুকের বিষফল মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন। এক্ষেত্রে যৌতুকের বিয়ে না পড়ানো, যৌতুকদাতা ও গ্রহীতার সব কাজ বর্জন করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম মতে যৌতুক বড় অপরাধ তা জাতির সামনে উপস্থাপন করে এভাবে যদি একটু সজাগ দৃষ্টি রাখা হয় তাহলে যৌতুকপ্রথা বন্ধের সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ আমাদের ইসলামের সঠিক পথ অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : তালেবে ইলম, দারুল উলুম হাটহাজারী চট্টগ্রাম