ঢাকা : ইসলামী বিধান অনুসারে একটি শব্দ ইসলামী সমাজকে নাড়া দেয় বলে আমার বিশ্বাস। আমরা ইতি-ঐতিহ্যসম্পন্ন একজাতি। নাম আমাদের মুসলিম। ধর্ম আমাদের ইসলাম। একটি ব্যক্তিগত মান-ইজ্জত যেমন আছে সবার, তেমনি কাজকর্মেও আলাদা একটি স্বকীয়তা আছে মুসলমানদের; আর সেই স্বকীয়তার মূলমন্ত্র যদি বলি। তবে বলব, নিয়তের কথা। বিশুদ্ধ নিয়তের কথা। অভিধানে ‘নিয়ত’ শব্দের দুটি অর্থ পাওয়া যায়। যার একটি স্থির, আর অন্যটি সংযম। চমৎকার দুইটি সামর্থ্যবোধক পেয়ে বেশ ভালোই লাগছে। কারণ তাতে লেখার ইতি খুঁজে পাই আর মুসলিম জাতির সমস্ত আমল বা কাজের অস্থিরতা দূরীকরণে ‘সংযম’ একটি শব্দই যথেষ্ট। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সব আমলের প্রতিদান নিয়ত অনুযায়ী (দেয়া হবে।) (বুখারি, মুসলিম) মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতফুল মুনয়িমে উল্লেখ আছে, ‘প্রত্যেক কাজ ব্যক্তির নিয়তের সাথেই যুক্ত।’
‘নিয়ত’ দ্বারা কী বুঝানো হয়, কী বা তার উদ্দেশ্য? নিয়ত বলতে আমাদের কী বুঝা উচিত? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবি বলে দিন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন-মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। (সুরা আলে ইমরান-১৬২) আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (র.) বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পৌঁছার দুটি সূত্র বর্ণনা করেছেন। এক. ‘দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই খালেছ করা।’ কোরবানির পশু কি জন্য কিনেছি? এত দামি, মোটাতাজা পশুটি! দেখলে মন জুড়ে যায়। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য, না অন্যের বাহ বাহ আর মারহাবা পাবার জন্য? দুই. ‘সকল আমল যেন নবী-রাসুলগণের সাথে মিলে যায়।’ অর্থাৎ সমকালীন নবী-রাসুলের সুন্নাত বা তরিকা অনুযায়ী হয়। আমার আপনার কোরবানি যেন নিয়তের ক্ষেত্রে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোরবানির সাথে মিলে যায়। তিনি যেমন আল্লাহর জন্যই কোরবানি করতেন, আমাদেরকেও তাই করতে হবে।
আমি নবীর উম্মত হিসেবে নবীর সুন্নত মুতাবেক আমার কোরবানি হচ্ছে কিনা চিন্তা করা। কোরবানির পশু কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব আমল বা কাজ যেন সুন্নত মতো হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। আমি না মানুষকে দেখানোর জন্য কোরবানি করছি, আর না মাশাআল্লাহ বা সুবহানআল্লাহ পেতে কোরবানি করছি। একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি পেতে কোরবানিসহ সব আমল করা। আমার আমল যেন আল্লাহর জন্য খাস থাকে, সেদিকে লক্ষ রেখে হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) তাঁর মোনাজাতে বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার সমস্ত আমলকে সৎ আমলে পরিণত করেন, তা কেবল আপনার জন্যই নির্ধারণ করেন আর তাতে যেন সামান্যতম দখল অন্যকে না দিয়ে পুরাই আপনার ভাগে রাখেন।’ (মাকতাবা শামেলা)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ইবাদত-বান্দেগি, জিকির-আজকার আর দোআ-মোনাজাতের সময় এমন সব দোয়া করতেন, যেমনটা তিনি তাঁর কোরবানির ক্ষেত্রে করতেন। বলতেন, “হে আল্লাহ! এটি আপনার পক্ষ থেকে আপনার জন্য।’ হাদিস বিশারদগণ এর ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে ‘আপনার থেকে’ এর অর্থ হলো আপনার ওপর ভরসা করে, আপনার কাছে সাহায্য চেয়ে পাওয়া বস্তু। আর ‘আপনার জন্য’ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, এই ইবাদত বা কোরবানি আপনার জন্যই।” (দেখুন, মাজমুয়ুল ফাতাওয়া, খণ্ড-১৪, পৃষ্ঠা-৯, ইবনে তাইমিয়্যা) আমাদের কোরবানির যাবতীয় কার্যাবলি যেন কেবল আল্লাহর জন্য হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে বেশি থেকে বেশি কোরবানির নিয়তকে বারবার শুদ্ধ, পরিশুদ্ধ ও যাচাই-বাছাই করা।
দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক আর বাৎসরিক সব আমলের ক্ষেত্রে আমাদের নিয়তকে সহিহ শুদ্ধ আর পরিশুদ্ধ করতে হবে। আসছে কোরবানির ঈদ। বাৎসরিক আমল। আমরা নিয়তকে সহিশুদ্ধ করি, কারণ আল্লাহতায়ালা উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা আর ছাগল দেখবেন না। দেখবেন আপনার আমার প্রকাশ্য আমল এবং গোপন নিয়ত। আমরা কোন নিয়তে কোরবানি করছি। আল্লাহকে খুশি করতে, না, লোক দেখাতে? হাদিসে পাকে এরশাদ হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলেন, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা দেখেন না তোমাদের মালদৌলত, দেখেন না তোমাদের বেশভুষা, দেখেন শুধুই তোমাদের অন্তর আর আমলের পরিশুদ্ধতা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৫৬৪) একই সূত্রে গাঁথা কোরবানির ফজিলতসহ আরেকটি হাদিস শরিফ বর্ণিত হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্যে কোরবানি করার চেয়ে অন্যকোনো আমল আল্লাহতায়ালার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন কোরবানির এই পশুকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ সবকিছু উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহতায়ালার নিকট (কোরবানি) কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করো।’ (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-১৪৯৩)
পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোশত, আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সুরা হাজ, আয়াত-৩৭) ইবাদতে মুখ্যবিষয় হলো আল্লাহর কথা মতে মতো প্রকাশ করে সব আমল করা। তেমনি কোরবানিতে গৃহপালিত পশু ইত্যাদি কোরবানি করা উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো আমার আপনার ভেতর বাহিরকে আল্লাহ কর্তৃক পরীক্ষা করা। আমরা কি দিয়ে এবং কীভাবে করছি তা কোনো আসল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো কোরবানি করতে গিয়ে আমার আপনার আমল আর নিয়তের পরীক্ষা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিশোধিত নিয়ত বুঝার এবং সে মতে আমলের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাসচিব, আশরাফুল উলুম মাদরাসা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
tanvirctg0316@gmail.com