গাজীপুর: গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম জমায়েতে আসা দেশি-বিদেশি ধর্ম প্রাণ লাখ-লাখ মুসল্লীদের আল্লাহু আকবর, আমিন-আমিন ধ্বনিতে মুখরিত ইজতেমা ময়দানসহ এর আশেপাশের এলাকা জুড়ে।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বাদ ফজর থেকে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে লাখ-লাখ মুসল্লির উদ্দেশ্যে চলছে পবিত্র কোরআন হাদিসের আলোকে অত্যন্ত তাপপূর্যপূর্ণ বয়ান। এ সময়ে দেশ বিদেশের বিখ্যাত আলেমগণ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করছেন।
ইজতেমায় মূল বয়ান উর্দুতে হলেও অংশ নেওয়া বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা করা হচ্ছে।
ধর্মীয় বয়ান ও কুরআন হাদিসের আলোকে ইমান ও আমলের উপর আলোচনা শোনে হাজার-হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা অঝরে অশ্রু ঝাড়াচ্ছেন। নিজেদের অতীত কৃতকর্মের কথা ভেবে। কেউ বা আবার উচ্চ স্বরে আল্লাহ আমি পাপী আমাকে মাপ করে দাও। আমি তো তোমারই বান্দা, তুমি মাপ না করলে এ করবে ক্ষমা।
দেশের ধর্ম প্রাণ মুসল্লীদের পাশাপাশি দেশের বাহিরের কম পক্ষে ২০ টি দেশের ধর্ম প্রাণ মুসলমানরা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মনোবাসনায় নিজের ঈমান, আমল ও আখলাককে পরিপপূর্ণ শুদ্ধরূপে গড়ে তুলতে গভীর দেনে বয়ান শুনছেন। এতে কোন ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ ধুলা, ময়লা, শীত,কিংবা হঠাৎ বৃষ্টি কোনটাই তাদের ইমানি শক্তিকে দাবিয়ে রাখতে পারছেনা।
সরেজনিনে, শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ইজতেমার ময়দানের পূর্ব পাশে অংশে সোনালী নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুমিল্লা থেকে ৭০ জনের কাফেলা নিয়ে আসা আ. রহমান জানান, তিনি এবার নিয়ে গেল ১০ বছর ধরে টঙ্গীতে আসছেন। তার সাথীরা কেউ রান্না ভান্নার কাজ না জানলেও সবাই এক জনের কাজে আরেক জন সহযোগীতা করছেন। তিনি বলেন, সাময়িক অসুবিধা হলেও আল্লাহর রহমতের আশায়। আনন্দের সঙ্গে মিলেমিশে থাকছেন সবাই।
এ দিকে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন, সুরুজ মিঞা। তিনি ২০ জনের এক কাফেলা নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। তাই তারা সাময়িক কষ্টকে কষ্ট মনে না করে এখানে আল্লাহ পাকের কাছে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করতে এসেছেন। তিনি বলেন, তাদের পাশেই ভারত থেকে এসেছে এক কাফেলা। তারা আরও অধিক কষ্ট করে এসেছেন। শুধু একটাই উদ্দেশ্য আখেরি মোনাজাতের অংশ গ্রহণ করে মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে পূর্বের পাপাচারের ক্ষমা চাওয়ার জন্য।
টঙ্গী ইজতেমা ময়দানের আয়োজন কমিটির সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল রোববার আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে। এর আগে হেদায়েতি বয়ান করা হবে। তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বীদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বী মাওলানা জুবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মোনাজাতে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হবে। আখেরি মোনাজাতে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নেবেন বলে আয়োজকদের ধারণা।
এবার টঙ্গী তুরাগ নদী পারের ৫৭ তম বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে পুরো টঙ্গী এলাকা জুড়েই উৎস আনন্দ বিরাজ করছে। দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে এ যেনো এক ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে টঙ্গী এলাকা। যেখানেই চোখ যায়। সেখানেই শুধু আল্লাহ পাকের গুনগান ও আমি-আমি ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
শনিবার সকালেই টঙ্গী শহর এবং ইজতেমাস্থল ও এর আশপাশ এলাকা যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। টঙ্গীর তুরাগ তীর বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। সকালেই টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন টঙ্গীর বাসিন্দা ও ইজতেমার মাঠে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে থাকা হাজার হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এবারের টঙ্গী ইজতেমার মাঠে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা দিতে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীদের মতো অগ্নি দুর্ঘটনা রোদে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সেরের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন,পুরো ইজতেমা ময়দান ৩৫৭ জন অগ্নি নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। তাৎক্ষণিক অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় প্রতি খিত্তায় ফায়ার এক্সটিংগুইসার, ফায়ার হুক ও ফায়ার বিটারসহ দুজন করে ফায়ার ফাইটার দায়িত্ব পালন করবেন।
এছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা ও ইজতেমা ময়দান পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য বিভিন্ন স্থানে তিনটি ফায়ার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানে ফায়ার সার্ভিসের সেবা পেতে ০১৯০১০২০৮৬৬ এই মোবাইল নম্বরে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ করা যাবে।
তালহা বিন জসিম আরও বলেন, ইজতেমায় দ্রুত অগ্নি নির্বাপণের জন্য তুরাগ নদীসহ ময়দানের চারপাশে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ১৪টি পোর্টেবল পাম্প প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এছাড়াও ময়দানের বিভিন্ন স্থানে তিনটি পানিবাহী গাড়ি, রোগী পরিবহনে চারটি অ্যাম্বুলেন্স, টু হুইলার, রেসকিউ কমান্ড ভেহিকল প্রস্তুত রয়েছে। নৌ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তুরাগ নদীতে রেসকিউ স্পিড বোট ও ডুবুরি দল রাখা হয়েছে। এছাড়া টঙ্গী, উত্তরা ও জয়দেবপুরের ফায়ার স্টেশনগুলো ইজতেমাকালীন স্ট্যান্ডবাই থাকবে বলেও জানান তিনি।
অপর দিকে প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার মাহবুব আলম জানিয়েছেন, দুই পর্বেই ইজতেমায় আইনশৃংখলা পরিস্থতি সুন্দর ও স্বাভাবিক রাখতে ইতিমধ্যে ছয় হাজার পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। তিনি বলেন, পুলিশ ছাড়াও আনসার র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনী প্রতি বছরের মতো নিয়োজিত রয়েছে। এই পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, আগত মুসুল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তায় পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, আকাশপথে হেলিকপ্টার টহল, ডগ স্কোয়াড টিম, ফুট প্যাট্রলিং, মোবাইল টিম, টহল টিম, নৌ টহল, সাইবার মনিটরিংসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর পক্ষ থেকেও ইজতেমার মাঠ ও এর আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেওয়া আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নেওয়া হয়েছে ৫ স্তরের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, দুই পর্বের আখেরী মোনাজাত শেষে মুসল্লিরা নিরাপদে ইজতেমার ময়দান থেকে বাড়িতে যেতে পারবেন এবং ইজতেমায় আগত সকল নিরাপত্তা নিয়ে র্যাব প্রস্তুত রয়েছে।তিনি জানান, নিরাপত্তা একটি সমন্বিত উদ্যোগ। এখানে যারা আছি প্রত্যেককেই এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। র্যাব শুধু নিরাপত্তাই নয়,ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাও দেবে। পুরো ইজতেমা ময়দানে প্রবেশের ১৮টি গেটে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন,এছাড়াও বিদেশি মেহমানদের কামড়ার গেটেও রয়েছে সিসি ক্যামেরা। রাত-দিন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে একটি মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও দুটি উপ-নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
সোনালীনিউজ/এমএস/এসআই