ঢাকা : চলমান করোনাভাইরাস মহামারির প্রলয় থেকে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট ব্যাধি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে নিরন্তন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।
এই সংকট মোচনের সম্ভাব্য উপায় হিসেবে বিশ্ববাসীর জন্য এরইমধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরির করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু সংকট উদ্ধারের প্রত্যাশা মূল্যাহীন করে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী রূপে আকস্মিক আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন মিউটেশন। ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ইউরোপীয় সেই সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার প্রতিটি প্রান্তে দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনার উর্ধ্বমূখী সংক্রমণ মাত্রাও এক ঝাটকায় চড়ে বসেছে লাল দাগে।
পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে করোনার আগ্রাসন কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে ভ্যাকসিন। করোনার নতুন মিউটেশনের ফলে আগের চেয়ে এর সংক্রমণের মাত্রা বহু গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে বর্তমানে মডার্না-ফাইজারসহ যে ভ্যাকসিনগুলো কোভিড-১৯ প্রতিরোধক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, সেগুলো প্রত্যাশিত ফল দিতে পারবে কি না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে করোনার সর্বশেষ মিউটেশনের বিরুদ্ধেও সফলভাবেই কাজ করতে পারবে তাদের ভ্যাকসিন।
এদিকে উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়ার ‘করোনা ভ্যাকসিন সিন্ডিকেট’ তৎপর হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে ইন্টারপোলের আগাম আশঙ্কা সত্যে পরিণত হতে পারে বলে ধারণা করছে বিভিন্ন মহল।
বিশেষ করে করোনার সর্বশেষ পরিস্থিতি আমলে নিয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদনে দ্রুত অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগে অপশক্তির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা জোরদার হতে পারে।
করোনার প্রথম প্রবাহ শুরুর পর পর বিশ্বব্যাপী যে সংকট সৃষ্টি হয় তার সুযোগ নিয়ে করোনা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের নকল পণ্যে সয়লাব হয় বিশ্ববাজার। যে জেরে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ভোগান্তি পৌঁছে চরমে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ভ্যাকসিনটি যেহেতু তার চেয়েও অনেক বেশি প্রত্যাশিত এবং গুরুত্বপূর্ণ তাই এক্ষেত্রেও এ ধরনের সিন্ডিকেট বিশ্বব্যাপী কালোবাজারের প্রকট বিস্তার ঘটাতে পারে।
এদিকে নিজেদের ভ্যাকসিনের বাজার ধরে রাখতে গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন (রূপান্তরিত রূপ) প্রতিরোধে নিজেদের ভ্যাকসিন কেমন কাজ করবে, তা পরীক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার ও মডার্না। তাদের আশা, সম্প্রতি উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনেই ভাইরাসটির নতুন ধরন মোকাবিলা সম্ভব হবে।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখনও করোনার নতুন ধরন চিহ্নিত হয়নি। তবে হতে পারে সেটি ইতোমধ্যেই দেশটিতে পৌঁছে গেছে, কিন্তু শনাক্ত হয়নি। একই সঙ্গে তারা করোনা নিয়ন্ত্রণ ও ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ সতর্কতার বার্তাও দেয়।
সিডিসির বিবৃত্তে বলা হয়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে সাইবার হামলার ঘটনা।
করোনা ভ্যাকসিনের গুরুত্বপূর্ণ নথি ও ডাটাবেজ তথ্য হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেও এই ধরনের তৎপরতা চালানো হতে পরে ধারণা প্রকাশ করা হয়। মডার্না বলেছে, ভাইরাসের নতুন ধরনটির বিরুদ্ধে তাদের ভ্যাকসিনে সৃষ্ট রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতাই যথেষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ তারা এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে।
পক্ষান্তরে ফাইজার বলেছে, ভ্যাকসিন নেয়া ব্যক্তিদের রক্তের নমুনায় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন কেমন আচরণ করে সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে তারা। ডিসেম্বরের শুরুতেই করোনার নকল টিকা বাজারে বিক্রি হতে পারে অথবা আসল টিকা চুরি হয়ে যেতে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে ইন্টারপোল। ফ্রান্সভিত্তিক পুলিশের এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি গত বুধবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বার্তায় বিশ্বব্যাপী এ সতর্কতা জারি করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন পুলিশ বাহিনীর মধ্যকার সমন্বয়ক সংস্থা হলো ইন্টারপোল।
সংস্থাটির সতর্কতা বার্তায় বলা হয়েছে, ১৯৪টি সদস্যদেশের পুলিশ বাহিনীকে এ বিষয়ে অরেঞ্জ অ্যালার্ট দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সংঘবদ্ধ একটি চক্র নকল টিকা বাজারে ও অনলাইন মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টা করতে পারে।
সতর্কবার্তায় আরও বলা হয়, মহামারির কারণে এরই মধ্যে বেশ ‘সুযোগসন্ধানী ও অপরাধপ্রবণ’ আচরণ দৃশ্যমান হয়েছে। অপরাধপ্রবণতাও বেড়েছে। আর এসবের পেছনে রয়েছে করোনার নকল টিকা প্রস্তুত করা ও আসল টিকা চুরির আশঙ্কা।
ইন্টারপোল জানায়, এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। যেহেতু করোনার টিকার অনুমোদন ও তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রক্রিয়া নিকটবর্তী, তাই টিকার সরবরাহ নিরাপদ করার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে টিকা বিক্রির ক্ষেত্রে অবৈধ ওয়েবসাইটের ব্যবহার চিহ্নিত করতে হবে।
ইন্টারপোলের সতর্কবার্তায় আরও বলা হয়েছিল, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো ধীরে ধীরে গণটিকাদান কর্মসূচির দিকে এগোনোর চিন্তাভাবনা করছে। এখন অপরাধী চক্রগুলো টিকার সরবরাহকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করতে পারে। ভুয়া ওয়েবসাইটে টিকা বিক্রির চেষ্টাও হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, এমনকি জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
ইন্টারপোলের মহাসচিব জুরগেন স্টক বলেন, করোনার টিকার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাসম্ভব প্রস্তুত থাকার প্রয়োজন রয়েছে।
সোমবার ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়- স্পাইক প্রোটিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘রিসেপটর বাইনডিং ডোমেইনে পরিবর্তন এনে ঘ৫০১ণ নামের নতুন একটি মিউটেশনের আত্মপ্রকাশে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যাবে এখন যেসব ভাইরাসের জেনেটিক অ্যানালাইসিস হচ্ছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওই বদলে যাওয়া রূপটিই পাওয়া যাচ্ছে। ভাইরাসের ক্ষেত্রে জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন খুব সাধারণ ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাইরাস তার জিনকাঠামোতে ওই পরিবর্তন আনতে পারে।
সেপ্টেম্বরে ব্রিটেনের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে প্রথম নতুন বৈশিষ্ট্যের এই করোনাভাইরাস মিউটেন্টটির সন্ধান মেলে। তারপরেই এটি ক্রমশ গোটা যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে অক্টোবরে ব্রিটেনে যারা আক্রান্ত হয়েছেন,তাদের ৫০ শতাংশই এই নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসের দ্বারা।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাওয়ার হাউজ খ্যাত, মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সফল যে দেশের চিকিৎসা প্রযুক্তি মহামারি করোনা যুদ্ধেও মানবতার কাণ্ডরি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল- সেই ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এদিন নতশিরে দাঁড়িয়ে ক্ষীন কন্ঠে তার বিবৃতিতে বলে গেলেন, করোনা তার ভোলপাল্টে ফেলেছে। বিজ্ঞানের কাছে একেবারেই অচেনা এক নতুন মিউটেন্টে আবির্ভূত হয়েছে। সে এখন সকল নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই