বছরে ভর্তুকি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা

কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১, ০৪:০০ পিএম

ঢাকা : নানা অনিয়ম ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও গুণগতমানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। গত ৫ বছরে এ সূচকে এগিয়েছে ৪৬ ধাপ। তার পরও কমছে না বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দেওয়া বড় ধরনের ভর্তুকি।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া এক বছরের ওভারক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় সমান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে। অনুমতি দেওয়া হয়েছে দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। তাই অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহ পদ্ধতিতে দুর্বলতার কারণে অপচয় রোধ সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, উৎপাদন ও বিতরণের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। সামনের দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হতে পারে। বাদ পড়তে পারে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ এবং দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

চলমান অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ চাহিদার অনুমান এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে বলে মনে করেন অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে উৎপাদন সক্ষমতার ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎ অব্যবহূত ছিল। বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় ২০২০ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ ভাগই ছিল অব্যবহূত।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার ৪৫ শতাংশ এবং তার আগের অর্থবছরে ৪৮ শতাংশ ব্যবহূত হয়েছে।

বিপিডিবির সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া এক বছরের ওভারক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় সমান।
বিপিডিবির নিজস্ব প্ল্যান্ট ছাড়া বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় তেল, গ্যাস, কয়লা বা অন্য জ্বালানি সরবরাহ করে বিপিডিবি। এর বাইরেও একটি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সরকারের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। তবে চাহিদা না থাকায় গ্রীষ্মকালে গড়ে প্রতিদিন আট হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। শীতকালে এটা আরও নেমে এসেছে। গত বছর সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।

আইইএফএ প্রতিবেদন বলছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র এক দশমিক ২৬ শতাংশ। রিপোর্টে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাবকে দায়ী করেছে।

প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ শতাংশ না বাড়ে, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশের বেশি অব্যবহূত থেকে যাবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন ১৫ হাজার ২৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা আছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ২১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে পুরনো কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হবে যেগুলোর সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫০১ মেগাওয়াট।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু ইতোমধ্যেই চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম, তা হওয়া সত্ত্বেও নতুন উৎপাদন কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

তিনি বলছেন, সরকারের একটা সেকশন পাওয়ার মিনিস্ট্রিকে বলেছে যে আমাদের দেশে এ রকম গ্রোথ হবে, বিদ্যুতের এ রকম ডিমান্ড হবে আরো বিদ্যুৎ উৎপাদনের দরকার হবে।

কিন্তু কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে যে পরিমাণ গ্রোথ হওয়ার কথা ছিল সেটা আমরা লক্ষ করিনি। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের বেশি কখনোই উৎপাদন করতে হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশে কখনো সমন্বিত পরিকল্পনা হয় না। মানে তারা যদি সমন্বিত পরিকল্পনা করত তাহলে কিন্তু তারা দেখতে পেত যে সে রকম গ্রোথ যেহেতু হচ্ছে না অতএব এ রকম পাওয়ার প্ল্যান্টের আমাদের প্রয়োজন নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রমবর্ধমান এই ওভারক্যাপাসিটি সরকারের ওপর আর্থিক চাপ ও বিদ্যুতের দামের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের মতে, ভুল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া মানে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের বোঝা হয়ে ওঠা। অলস পড়ে থাকা এই কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে বলে চুক্তি করেছিল সেটি নেওয়ার দরকার না হলেও চুক্তি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ঠিকই দিতে হয়েছে।

যেমন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হিসাবে গত ছয় বছরে বিদ্যুৎ বিভাগের তাতে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছেন, যদি আমি চাহিদার চাইতে বেশি বিনিয়োগ করে ফেলি, তাহলে আমাদের যে মূল্যবান অর্থ রয়েছে যা অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে পারতাম, অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারতাম, সেই অর্থটা সাশ্রয় হতো। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করেই বিনিয়োগ করা উচিত। তাহলে অন্য খাতে সেই অর্থটা ব্যয় করে একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অন্যদিকে মানুষের সামাজিক উন্নয়নকাজ করা যেত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম বলেন, সবমিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তার মতে, প্রথম বিপত্তি হচ্ছে ডিমান্ড এস্টিমেশন, যে আমার প্রতি বছর কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, সেটার বিপরীতে আমি উৎপাদন ক্ষমতার কী পরিমাণ প্রবৃদ্ধি দরকার, তার একটা প্রক্ষেপণ তৈরি করতে হয় এবং সেই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনকাজে হাত দিতে হয়। কিন্তু এখানেই ডিমান্ড এস্টিমেশন অ্যাকচুয়াল ডিমান্ডের তুলনায় অনেক বেশি করে ধরা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, একটি বেজলোড বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৪ ঘণ্টাই চলতে পারে। তবে সরকার যেগুলো অনুমোদন দিয়েছে এর বেশির ভাগই পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পিক আওয়ারে প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টা চলতে পারে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ভুল পরিকল্পনার ফসল। কেন এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে তা একটি রহস্য। এর মধ্যে বেশির ভাগ কেন্দ্রই উন্মুক্ত দরপত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্মিত হয়নি।

শামসুল আলম বলেন, ক্ষমতাসীন কিছু মানুষ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে অলস বসে থেকে সরকারের কাছ থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে যাচ্ছে। এভাবেই একটা অংশকে ব্যবসা করতে দেওয়ার জন্যই বেশির ভাগ ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

তবে বিদ্যুতের সক্ষমতা সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বলেন, এক বছরে বিদ্যুৎ সক্ষমতার কতটা উদ্বৃত্ত থেকে গেছে, সেটা হিসাব করা উচিত না। আমাদের দৈনিক চাহিদা এবং সর্বোচ্চ উৎপাদনের হিসাব করতে হবে। তিনি বলেন, সক্ষমতার মধ্যে ৩৫ শতাংশ বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজন।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজের চলার জনই পাঁচ শতাংশ বিদ্যুৎ লাগে, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাগে ১০ শতাংশ, স্পিনিং রিজার্ভের জন্য ১০ শতাংশ এবং সিস্টেম লসের জন্য আরো ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ লাগে। এই হিসাবে বিপিডিবির প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ক্ষমতা রয়েছে তা এক দিনে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের জন্যই দরকার। তবে আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছি। সামনে চাহিদা বাড়বে বলেই আমরা প্রত্যাশা করছি। বিদ্যুতের ঘাটতিতে আমরা পড়তে চাই না।

সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, নতুন পরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছে সরকার। সামনের দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হতে পারে। যেটা হয়েছে যে আমরা টার্গেট করেছিলাম ২০৪১ সালে আমাদের চাহিদা হবে ৫০ হাজার মেগাওয়াটের মতো।

যার বিপরীতে আমরা উৎপাদন পরিকল্পনা করেছি ৬০ হাজার মেগাওয়াট। আমরা ধারণা করেছিলাম ২০২০-এ আমাদের চাহিদা হবে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু ১৩ হাজারের ওপরে ওঠেনি। সেই কারণে আমরা এখন রিভাইজ করছি এবং উৎপাদন পরিকল্পনাটা আমাদের কমে আসবে। সেটা আমরা রিভিশন করব।

তিনি আরো বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা এবং মূল্য বিবেচনায় কয়লাকে আগে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন তাদের সামনে বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের তালিকায় দেখা যাচ্ছে সিংহভাগই গ্যাস ও সৌরবিদ্যুতের। উৎপাদন কমালে কয়লাকেই ধীরে ধীরে বাদ দিতে হতে পারে।

কয়লা বা তেলভিত্তিক যেসব পরিকল্পনা আমরা নিয়েছিলাম তা আমরা রিভাইজ করব। স্বাভাবিকভাবেই যদি কাটছাঁট করতে হয়, যেহেতু কয়লা সবচেয়ে ডার্টি এনার্জি এবং যেটা আমরা শুরুতে চিন্তা করেছিলাম যে কয়লার শুরুতে দাম কম পড়বে কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে কয়লা এবং এলএনজির দাম প্রায় কাছাকাছি। সোলারটাও কিন্তু অনেক কমে আসছে। ২০১০ তুলনায় বর্তমানে সোলার প্যানেলের দাম ৬০ শতাংশ কমে আসছে।

লিস্ট কস্ট চিন্তা করে কয়লাকে আমরা যেভাবে প্রাধান্য দিয়েছি, এখন আর সেভাবে দেখছি না। উৎপাদন পরিকল্পনায় যখন আমরা ডাউনসাইজ করব তখন কয়লাটাকে হয়তো প্রথমেই আমাদের ডাউনসাইজের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই