দুর্নীতি তদন্তের নামে ষড়যন্ত্রের ছক

দেশে সক্রিয় ভিনদেশি গুপ্তচর

  • এস এম সাব্বির খান | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১, ০৬:৩৯ পিএম

ঢাকা : সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করে ফের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে কাতারভিত্তিক বার্তা সংস্থা আল-জাজিরা। 

‘চাঞ্চল্যকর’ এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে দেশের সরকার ব্যবস্থা ও সামরিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করেছে গণমাধ্যমটি। প্রতিবেদনটিতে যেমন গণমাধ্যম নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে তেমনি স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য প্রকাশ করে সাংবাদিকতার বিবর্ণরূপ উপস্থাপন করেছে। 

তাছাড়া তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনেও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্ক। শুধু তাই নয়, বিতর্কিত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতায় এরইমধ্যে তাদের এই ‘বিশেষ প্রতিবেদন’ যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এটি যে, একটি ‘টার্গেটেড মিডিয়া অ্যাসলট’; তা এরইমধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে এর সত্যতা উঠে এসেছে। 

তবে আল-জাজিরা সম্পর্কে সর্বশেষ যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানা গেছে তা হলো, দুর্নীতি তদন্তের নামে বাংলাদেশ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ছক কষতে ঢাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে আল-জাজিরার একটি গুপ্তচর চক্র। ইতোমধ্যে এদের অন্তত পাঁচ জনের ব্যাপারে গোপন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানান তথ্য। যার প্রেক্ষিতে বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এখানেই শেষ নয় বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অপচেষ্টা সামনে আরও চলবে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার এমন নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশের ইতিহাস রয়েছে আল-জাজিরার। শুধু তারাই নয়, ২০১৮ সালে বার্টলসম্যান স্টিফটুং নামক একটি জার্মানভিত্তিক অনিবন্ধিত ও বিতর্কিত বেসরকারি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে প্রথম স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দেয়।

পরবর্তীতে সেখান থেকেই ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারকে বিভিন্ন সময় স্বৈরশাসক হিসেবে অভিহিত করার অপচর্চা শুরু হয় বেশকিছু মহলে। ঘটনাক্রমে আল-জাজিরার বার্গম্যানের মত সেই সংস্থাটিও ইহুদি সমর্থিত এজেন্টদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

এই সংস্থাটি ঠিক সেই সময় বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের উত্থান সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে যখন কিনা সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে নুন্যতম সময়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল বাংলাদেশ। আর আল-জাজিরার এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো- যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর এরইমধ্যে বিভিন্ন  গণমাধ্যমে গুঞ্জন চলছে। আল-জাজিরার পক্ষে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ৪ সংবাদকর্মী। এদের মধ্যে অন্তত দুজন মূলধারার গণমাধ্যমে উচ্চপদে আছেন। একজন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত। অন্য দুই জন এনজিও কর্মী। 

এনজিও কর্মীদের মধ্যে একজন বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর পর তার এনজিও থেকে ওই ঘটনার বানোয়াট তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। এজন্য তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছিল।

জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধানে তারা তথাকথিত আল-জাজিরা ইনভেস্টিগেটিভ টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করছে। আল-জাজিরা তাদের ভাড়া করেছে। 

সম্প্রতি আল-জাজিরার জেমস ক্লেনফিন্ড নামীয় একজন ফেসবুকে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য আহবান করেছেন। 

জানা গেছে, বাংলাদেশে বিএনপি-জামাতপন্থী সাংবাদিকদের কয়েকজন আল-জাজিরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন। আল-জাজিরা বাংলাদেশ নিয়ে যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করার প্রকল্প নিয়েছে- তাতে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে, লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা। 

বাংলাদেশে থাকা বিএনপি-জামাত জোট নিযুক্ত কিছু সাংবাদিক মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আল-জাজিরার নিজস্ব অনুসন্ধান ছাড়াই উন্নত প্রযুক্তির নানারকমের এডিটিংয়ের পর বানোয়াট প্রতিবেদন তৈরি করে আল-জাজিরাকে দেয়। বিশ্বাস আর অর্থলিপ্সায় গণমাধ্যমটি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে এখন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আল-জাজিরার সম্পাদনা বিভাগের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেছেন। 

জানা যায়, আল-জাজিরার মধ্যেই বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা নিয়ে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সম্পাদকীয় প্যানেলের কয়েকজন বিষয়টি অশোভন এবং বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলেও স্বীকার করেছেন। সম্পাদকীয় বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ের একাধিক ব্যক্তি। তারা এ বিষয়ে দু:খ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। 

তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পলাতক কয়েকজন তথাকথিত সাংবাদিক, বাংলাদেশে থাকা কিছু বিএনপি-জামাত অনুরক্ত সংবাদকর্মী এবং টকশোতে সরকারের পক্ষে কথা বলা খোলসধারী- গোপনে বিদেশে অবস্থানরত ওই সংবাদকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কিছু সংবাদকর্মী বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায় রশদ যোগাচ্ছে। 

সরকারের একাধিক শীর্ষ ব্যক্তি বলেছেন ‘আল-জাজিরার এই রিপোর্ট, দেশের মানুষই প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা যে অসৎ উদ্দেশ্যে এই অপ-প্রচার চালিয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেছেন, আল জাজিরার তথ্যচিত্রে যেসব ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনের বাংলাদেশের সৈন্যদলে সেরকম কোন সরঞ্জাম নেই। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ সাতটি মানবাধিকার সংস্থার একটি বিবৃতিতে বলেছে, আল জাজিরার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে যেসব অভিযোগ এসেছে, তাতে তারা উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘকে এসব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছে।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে ভাসান চরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ইস্যুতে এই ৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে- নৌবাহিনীর হাতে ভাসান চরে রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল। যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর রোধ করা। 

যার প্রেক্ষিতে কূটনৈতিক পর্যায়ের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রশ্ন তুলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুতে বাংলাদেশ যেন আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন না পায় সেটা নিশ্চিত করতেই আল-জাজিরার এই বাতুলতা নয় তো? তা না হলে সারা বিশ্বের গণমাধ্যম যখন মিয়ানমারের সেনা ক্যু নিয়ে উত্তাল ঠিক তখনই কেন আল-জাজিরার বাংলাদেশ সরকার ও দেশের সেনাবাহিনী বিরোধী এই প্রোপাগান্ডা প্রকাশ্যে এলো?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরণের বিতর্কিত তথ্য প্রকাশ মূলত রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরানোর নয়া গেমপ্ল্যান। এমনটা করা হচ্ছে যাতে করে, সমালোচনার মুখে এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রাপ্তির পথ দুর্গম হয়।

সাবেক নির্বাচন কমিশন প্রধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, প্রবীণ সাংবাদিক এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাদের বক্তব্যে বলেন, মিয়ানমারের ‘সেনা ক্যু’ বাংলাদেশের দুর্নীতি অনুসন্ধানের আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন প্রকাশের এই পটভূমি- একই সূত্রে গাঁথা। 
 

সোনালীনিউজ/এমটিআই