অন্তর্দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ, সমন্বয়হীনতায় বিএনপি

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২১, ০৪:৫০ পিএম

ঢাকা : দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতরে চলছে অস্থিরতা। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছাতে ব্যস্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে দল গোছানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ইস্যু সামনে পেয়েও সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি দলটি। এ জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তৃণমূলসহ বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতাই রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে না পারার বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডকে দায়ী করছেন।

দলের সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ চায় রাজপথে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ গণসম্পৃক্ত বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করতে। কিন্তু দলের আরকেটি অংশ ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বনের পক্ষে। তাদের মতে নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি আছে। এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তবে দলের আরকেটি অংশ এই মতের বিরোধী। তারা এখন রাজপথ উত্তালের পক্ষে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় গত ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে দলের ভাইস-চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে পেশাজীবী পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল। এ সম্পর্কে দলের হাইকমান্ড কিছুই জানত না।

সেদিন ২০ দল শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমীর জানাজার পর গুলিস্তান ও পল্টন এলাকায় হঠাৎ করে পেশাজীবী পরিষদের ব্যানারে বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক অবস্থান নেন।

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন শওকত মাহমুদ, সাদেক খান ও কল্যাণ পার্টির সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। পরে লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ে নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ ঘটনার পর শওকত মাহমুদকে দলের পক্ষ থেকে শোকজও করা হয়। যদিও শোকজের কারণ সম্পর্কে জানা যায় তিনি কুমিল্লায় নিজ এলাকায় দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন।

একই সময়ে শোকজ করা হয় দলের আরকে ভাইস-চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকেও। এই বিক্ষোভ মিছিলে মেজর (অব.) হাফিজ অংশ না নিলেও তিনি জানতেন। তবে তাকে শোকজের নেপথ্যের কারণ ছিল তিনি দলের হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেন এবং তাকে দেওয়া দায়িত্ব তিনি সঠিকভাবে পালন করেন না বলে। তাকে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি তা করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ড. শফিক রেহমানসহ আরো অনেকেই। তাদের মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রকাশ্যেই লন্ডনে ফেরারি তারেক রহমানের নেতৃত্বের সমালোচনা করেন। এসব কারণেই তার কোনো পরামর্শই এখন আমলে নেয় না বিএনপির দাপুটে অংশ।

বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতা রাজপথে আন্দোলনের পক্ষে। এ জন্য দলীয় ফোরামের ভেতর এবং বাইরেও তারা হাইকমান্ডকে বারবার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি গুলশানের লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সূচনা অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে দলটির ভাইস-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, আমাদের অলসভাবে বসিয়ে রাখবেন না। ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত করে আমাদের দায়িত্ব দিন।

একই অনুষ্ঠানের দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা এখন বুড়ো হয়ে গেছি। হয়তো সক্রিয়ভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে আগের মতো সশরীরে থাকতে পারব না। আমাদের অভিজ্ঞতা আপনাদের কাজে লাগাতে পারবেন।

এদিকে নেতৃত্ব নিয়ে তৃণমূল নেতাদের মনোবলও ভেঙে গেছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য নেতৃত্বের পরিবর্তন ও সংস্কার চাচ্ছেন। বিগত বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের ভরাডুবির পর রাজনীতিতে ফিরতে দলীয় মহাসচিব পদের পরিবর্তনের আলোচনা চলছে। এসব নেতারা কাউন্সিলের মাধ্যমে মহাসচিব পদের পরিবর্তন চান। তবে খালেদা জিয়া ছাড়া তারা কোনো কাউন্সিল চান না।

অন্যদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক নেতৃত্বের সমালোচনা করায় বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কথাও মানছে না দলটির শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ। এতে চরম দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন দলের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা।

সার্বিক বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের ভোট ডাকাতির কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা পারাজিত হলেও হতাশ নয় তৃণমূল। দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কোনো প্রশ্নই আসে না। ভবিষ্যতে সবার কথা চিন্তা করে সব বিষয়ে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় এমপি-চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালীদের নিজস্ব বলয় তৈরির মানসিকতার কারণে নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে অনেক ত্যাগী নেতা। ফলে কমিটি গঠন করতে বিভিন্ন স্থানে দেখা দিচ্ছে দ্বন্দ্ববিরোধ। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বিরোধ আরো বেশি প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনের আগে-পরে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ২৮-৩০টি জেলার সম্মেলন করতে পারে দলটি। যেখানে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। করোনার কারণে দীর্ঘ সময় দলীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর সেপ্টেম্বরে পুনরায় তা শুরু হয়েছে। এর পর বেশ কয়েকটি সাংগঠনিক জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি দলীয় কার্যালয়ে জমা পড়লেও সেগুলো নিয়ে আপত্তি ওঠে।

দলীয় ‘মাই ম্যান’দের সেসব কমিটিতে স্থান দিয়ে ত্যাগীদের বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় ওইসব কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন। একইভাবে আওয়ামী লীগের সব উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারছে না দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে।

সম্প্রতি সিলেটের গোলাপগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা রফিক আহমদকে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম ওয়াদুদ এমরুল। তাকে যেখানে পাবেন সেখানেই জুতাপেটা করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তার এই ঘোষণা সংবলিত ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি, বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য।

সম্প্রতি দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। সর্বশেষ নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের বসুরহাটে আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে একজন নিহত হন। এসব ঘটনায় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। দলের নেতা-কর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়ার চার দিনের মাথায় নগরীর পাঠানটুলিতে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে দলটির একজন কর্মী নিহত হন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে ২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষের ৮৬টি ঘটনায় ২৩ জন নিহত এবং এক হাজার ৪৫৩ জন আহত হয়।

একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৬টি। তাতে একজন নিহত এবং ১৫১ জন আহত হয়। বিএনপির সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে ৩টি। এতে আহত হয়েছেন ৬৩ জন। নিহত হয় একজন।

এসব প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলে অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা আছেন। নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ছোটখাটো কিছু দ্বন্দ্ব থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে সবসকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। সবকিছু বিবেচনা করে যোগ্য নেতাদের হাতেই দলের নেতৃত্ব তুলে দেবেন দলীয় সভানেত্রী।

সোনালীনিউজ/এমটিআই