ঢাকা : চরম অর্থ সংকটে পড়েছে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা কর্মজীবীরা। মাসের পর মাস বাসা ভাড়া দিতে না পেরে বাধ্য হচ্ছেন গ্রামে চলে যেতে। তাই বাড়ির মালিকদের মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভাড়াটিয়ারা।
কিন্তু বাড়িওয়ালারা বলছেন, ভালো নেই তারাও। কারণ বাড়ি ভাড়ার ওপরই সংসার চলে অধিকাংশের। এদিকে সংকট নিরসনে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ বিশিষ্টজনদের।
জানা গেছে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা মহামারীর কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হয়ে গেছে ছোট বা বড় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর চাকরি হারিয়েছে কয়েক লাখ কর্মজীবী। শুধু তাই নয়, যারা এখনো চাকরি করছেন তাদের অধিকাংশেরই বেতন কমিয়ে দিয়েছেন মালিকপক্ষ। পাশাপাশি বেতন অনিয়মিত হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়, করোনার কারণে এক বছরে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দেড় কোটি মানুষ।
সিপিডির গবেষণাবিষয়ক পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, করোনা দুর্যোগের সময় ৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। শহর অঞ্চলে ইনফরমাল ইকোনমি থেকে ৬.৭৮ শতাংশ কর্মজীবী কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
এ ছাড়া উচ্চ পর্যায়েও অনেককে চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাকরি হারিয়েছেন এসএমই ও ইনফরমাল সেক্টর থেকে।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যয়বহুল এই রাজধানীতে লাগামহীন বাসা ভাড়া নিয়ে সংকটে পড়েন অনেক কর্মজীবী। একই সাথে বাসা ভাড়া দিতে না পেরে এরই মধ্যে রাজধানী ছেড়েছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের অনেক পরিবার। রাজধানীর মালিবাগে দুই বেড রুমের একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নকিব খান। করোনার কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের বেতন তার কমানো হয় ৫০ শতাংশ। বেতন কমে যাওয়ায় তার পক্ষে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
বলেন, বাড়ি ভাড়াটা এই সময়ে তার জন্য বড় ধরনের মাথাবৗথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাসা ভাড়া পরিশোধ করে সংসার চালানোটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাসা ভাড়া দিতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরের অনেক চাকরিজীবী। তাই ওই এলাকাটির ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে এখন ব্যাচেলার বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
ওই এলাকার ৬ তলা একটি বাড়ির মালিক ওবায়দুল্লাহ জানন, করোনার কারণে গত বছরে তার ৪টি ভাড়াটিয়া গ্রামের বাড়ি চলে যায়। চলতি বছরে আরো ৩ টি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া চলে গেছে। বাধ্য হয়ে তিনি ওই খালি হওয়া ৭টি ফ্ল্যাটের ৩টিতে ব্যাচেলর ভাড়া দিয়েছেন বলে জানান। বর্তমানে ১ হাজার ৪৬৩ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটারের এই ঢাকা শহরে বসবাস করছে প্রায় দুই কোটি মানুষ।
কর্মসংস্থানসহ উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিনিয়ত ভিড় করছে এই শহরে। ফলে লাগামহীনভাবে বেড়েছে এই শহরের বাড়ি ভাড়া। তাই রাজধানীতে বসবাসকারীদের তাদের আয়ের অর্ধেকের বেশি ব্যয় করতে হয় বাড়ি ভাড়ায়।
রাজধানীর মতিঝিলের একটি বেসরকারি স্কুল শিক্ষক বলেন, বাড়ি ভাড়া বাবদ তাকে মাসে ১৬ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। এক বছর আগেও স্কুলে বেতন ও টিউশনির মাধ্যমে উপার্জিত আয় দিয়ে অনায়াসে এই ভাড়া তিনি পরিশোধ করতে পারতেন। কিন্তু করোনার কারণে গত এক বছর ধরে স্কুলের বেতন অর্ধেকে নেমে এসেছে। টিউশনিও বন্ধ।
যে অর্থ পাচ্ছেন তা দিয়ে পরিবারের খাবার ব্যয় মেটানো গেলেও বাসা ভাড়া দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত এক বছর ধরে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করছেন বলে জানান।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে পণ্য মূল্যের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ।
তাদের হিসাব অনুযায়ী গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ।
তাদের আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাজধানীর ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন তাদের বাসা ভাড়া পরিশোধে।
বাড়ি ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতে নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বাহারানে সুলতান। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। নিম্নআয়ের মানুষের হাতে টাকা নেই। কিন্তু বাড়িওয়ালারা তো আর তা বুঝতে চাইবেন না।
তিনি বলেন, গত বছর লকডাউনের ফলে কী রকম মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা সকলে দেখেছি। সেই লকডাউনে অনেক চাকরি হারিয়ে এখনো চাকরি পাননি। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আগের লকডাউনের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই পুনরায় লকডাউনের ফলে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনাকালে অনেকে চাকরি ও কাজ হারিয়ে নিজ এলাকায় চলে গিয়েছিলেন। তাদের অনেকে ফের ফিরে এসেছেন। তাদের অনেকেই অল্প আয়ের কাজ করে কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছেন, অনেকে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে চাপে পড়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়াদের টাকার জন্য নানা হয়রানি করছেন। বাড়ি ছেড়ে দেওয়ারও হুমকিও দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বাড়ির মালিকদের আরো বেশি মানবিক হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে বাড়িওয়ালার বলছেন, বাড়ি ভাড়া না পেলে তাদের নানান সদস্যায় পড়তে হবে। তাই বাধ্য হয়ে তারা ভাড়ার জন্য চাপ দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, চাকরি জীবনের সব সঞ্চয় ও সেইসাথে ঋণ নিয়ে ৫ তলা বাড়িটি তিনি নির্মাণ করেছেন। ভাড়ার টাকা দিয়েই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। সেইসাথে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংসারের ব্যয়ের জন্যও এই ভাড়ার ওপরই তাকে নির্ভর করতে হয়। করোনার কারণে তার কয়েকজন ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ার পর ফ্ল্যাট দীর্ঘ সময় খালি থাকায় অর্থনৈতিক চাপে পড়েন বলে জানান তিনি।
এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদের মতে, বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটের মধ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধান করতে হবে সরকারকে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে যাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, তারা কীভাবে বাড়ি ভাড়া দেবেন?
সে ক্ষেত্রে সংক্রামক আইন অনুযায়ী যে উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে সেই কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের কাছে একটা সুপারিশ জমা দিতে পারে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী সরকার একটা প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। ওই প্রজ্ঞাপন না মানলে তা হবে অপরাধ।
সোনালীনিউজ/এমটিআই