১৫ বছরে চট্টগ্রামে প্রাণহানি ৩ শতাধিক

বর্ষায় আতঙ্ক বাড়ছে পাহাড়ে

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২১, ০৭:৩৩ পিএম

ঢাকা : কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় কালারমারছড়া ইউনিয়নে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস শিশু সুমাইয়ার পরিবারের। ৬ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। বাড়ির উঠোনের এক পাশে খেলাধুলায় মগ্ন ছিল আড়াই বছরের শিশু সুমাইয়া। হঠাৎ পাহাড়ধসে মাটি চাপা পড়ে মারা যায় শিশুটি। 

এর আগের দিন ৫ জুন ভারি বর্ষণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলাদা দুটি পাহাড়ধসের ঘটনায় নারীসহ দুই রোহিঙ্গা নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। 

প্রতি বছর বর্ষা এলে এভাবেই পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণহানি বাড়তে থাকে। ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

পরিসংখ্যান বলছে, পাহাড়ধসের ঘটনায় গত ১৫ বছরে কেবল চট্টগ্রামেই প্রাণহানি ঘটেছে ৩ শতাধিক। তিন পার্বত্য অঞ্চলে মৃত্যুর এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

২০১৭ সালের জুনে তিন পার্বত্য অঞ্চলে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১৫৬ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ওই ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত চার সেনাসদস্যও প্রাণ হারান। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষের যেন টনক নড়েনি। কেবল প্রতি বছর বর্ষা এলেই কিছু দায়সারা অভিযান আর তৎপরতার বাইরে কার্যত পাহাড়ধসের কারণ কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ বসতি গড়ে ওঠা বন্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে দেখা যায় না।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে ২৫টি। এসব পাহাড়ে কম ও বেশি ঝুঁকিতে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা লাখের ওপরে, যাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের। এর মধ্যে ১৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের তালিকা করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। বাকি পাহাড়গুলোর তালিকা এখনো শেষ হয়নি। 

পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী বাড়ছে।

যদিও স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পাহাড় মালিকদের উদাসীনতা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেওয়া ও পুনর্বাসনে সফলতা আসছে না। উল্টো আবাসনগত সব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কারণে পাহাড়ে বসতি বাড়ছে।

এ বছর বর্ষাকাল মাস শুরু হতে বাকি আর মাত্র কদিন। কিন্তু এরই মধ্যে পাহাড়ধসের ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘পাহাড়ের পাদদেশে যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে তাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য মাসিক কিস্তির ভিত্তিতে স্বল্পমূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে। কিন্তু সেটা না করে বর্ষা এলেই পরিবারগুলোকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করে প্রশাসন।’

কেবল প্রাণহানিই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গাছ কাটা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার কথা জানান তিনি। একই সাথে যারা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান আবু নাসের খান। 

এদিকে বর্ষায় পাহাড়ধস ও প্রাণহানির শঙ্কায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত ৬ জুন ১৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে। ধসের আশঙ্কায় নগরীর আকবর শাহ, শাপলা আবাসিক এলাকা, বিশ্বকলোনি, টাইগার পাস, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, বায়েজিদসহ বিভিন্ন পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন।

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুল্লাহ নূরী ফিরোজ শাহ বলেন, মতিঝর্ণা পাহাড়ে ১০ হাজার লোকের বসবাস। এ ছাড়া ২৫টি পাহাড়ে লাখের ওপর মানুষ ঝুঁকিতে। কিন্তু তাদের সরানো যাচ্ছে না। সরাতে গেলে আন্দোলন শুরু করে। জোর করে সরানো হলে কিছুদিন পর আবার বসতি গড়ে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, ‘বর্ষা এলেই পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কার্যকর নয়। বর্ষায় কেন সরাতে হবে? দরকার স্থায়ীভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। নয়তো পাহাড় রক্ষা সম্ভব নয়।’

জানা গেছে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের পাদদেশে খুপরি ঘর ভাড়া দেয় এলাকার কিছু চিহ্নিত লোক। যারা পাহাড় বিক্রি করে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। চট্টগ্রামে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ৭টি পাহাড় অবৈধভাবে দখল করে আছে প্রভাবশালীরা। 

তারা বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার ছাড়াও পাহাড়ে কাঁচা, সেমিপাকা ও বহুতল পাকা ভবন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে তুলেছে। এসব স্থাপনার বেশিরভাগই মাটি কেটে কয়েক ধাপে ওপরে-নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ঘর-বাড়ি কম টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ থাকায় নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষ সেখানে বসবাস করেন। 

অন্যদিকে পাহাড় কেটে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক করায় ওই সড়কটিকে ঘিরে নতুন করে ওই এলাকার পাহাড়ে বসতি বেড়েছে। গত দুই বছরে সড়কের দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি গড়ে তুলেছেন কয়েক হাজার পরিবার।

এছাড়া কক্সবাজারের উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ সূত্র বলছে, তাদের আওতায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বনভূমি রয়েছে। এসব বনের বেশিরভাগই পাহাড়শ্রেণির। গত ১০ বছর আগেও কক্সবাজারে অনেক উঁচু পাহাড় ছিল। কিন্তু পাহাড়খেকোদের কবলে পড়ে তা এখন স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পরিবেশ অধিপ্তরের উপপরিচালক নেজাম  উদ্দিন বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। পাহাড় কাটার বিষয়ে মামলাও হয়েছে।’

পরিবেশবাদী সংগঠন এবং স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের লোকজনকে ম্যানেজ করেই পাহাড়ে চলে এসব অবৈধভাবে গাছ ও মাটিকাটার পাশাপাশি অবৈধ বসতি গড়ে তোলার কর্মকাণ্ড। তাই এসব অভিযান লোক দেখানো ছাড়া কিছুই নয়। প্রশাসন আন্তরিক হলে পাহাড়কে ঘিরে অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করা কোনো কঠিন বিষয় নয় বলে মনে করেন তারা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই