ঢাকা : করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় ভ্যাকসিন। যার ওপর নির্ভর করছে অচল হয়ে পড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সচল হওয়ার নিশ্চয়তা। একারণে সরকারও ভ্যাকসিন আমদানির ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত টিকা পাওয়া নিয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে কিংবা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরো কিছু পাওয়ার কথা রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। অথচ সদ্য ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিকভাবে ১২ কোটি মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিমাসে ২৫ লাখ করে ভ্যাকসিন দেওয়ার টার্গেট নির্ধারণ করেছে সরকার।
কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে ভ্যাকসিন না পাওয়ায় সরকারের প্রতিমাসে ২৫ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১২ কোটি মানুষকে ২৪ কোটি ভ্যাকসিন দিতে প্রায় ৭ বছর লেগে যাবে। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মতে, যেহেতু করোনা নিয়ন্ত্রণের ওপরই নির্ভর করছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ, তাই বাজেটে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ সবকিছুই নির্ভর করছে করোনার ওপর। করোনাকে যতদিন না দূর করা যাবে ততদিন কোনো অগ্রগতি হবে না। শুধু ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিলাম আর টিকা হয়ে গেলো তাতো হবে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকার মাসে ২৫ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই রেটে টিকা দেওয়া হলে ১২ কোটি লোকের ২৪ কোটি টিকা দিতে ৭ বছর লাগবে। সে হিসেবে দিনে ১ লাখেরও কম লোকে টিকা পাবে। যেখানে দিনে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ লোককে টিকা দেওয়া দরকার। তাহলে ৫-৬ মাসের মধ্যে টিকা দেওয়া সম্পন্ন হবে। ৭ বছর দীর্ঘসময়। এটা গ্রহণযোগ্য না।’
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে মোট এক কোটি ৬০ হাজার ৮৭১ ডোজ। বর্তমানে মজুত আছে মাত্র এক লাখ ৩৯ হাজার ১২৯ ডোজ। এক কোটি ৬০ হাজার ৮৭১ ডোজের মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৬ জন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ ভ্যাকসিনের আশ্বাস পাওয়া গেলেও কবে নাগাদ কি পরিমাণে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না সরকার।
শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ লাখ ৮০০ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কবে নাগাদ তা হাতে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
এছাড়া, আগামী ১৩ জুন চীন থেকে ৬ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসবে দেশে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা দূতাবাসের মিনিস্টার কাউন্সিলর ও ডেপুটি চিফ অব মিশন এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, চীনের বেইজিং থেকে শুক্রবার ৬ লাখ ভ্যাকসিন ঢাকার উদ্দেশে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আর কোভ্যাক্স থেকে ফাইজার-বায়োএনকেটের তৈরি ১ লাখ ৬২০ ডোজ ভ্যাকসিন গত ১ জুন বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে। যদিও এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার বেশ ব্যয়বহুল এবং জটিলও বটে।
ফাইজার-বায়োএনটেকের ওই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে হয় হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। ফলে এ ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে আল্ট্রা কোল্ড ফ্রিজারের প্রয়োজন হয়। আর পরিবহনের জন্য থার্মাল শিপিং কনটেইনার বা আল্ট্রা ফ্রিজার ভ্যান লাগে।
সাধারণ রেফ্রিজারেটরে ২ ডিগ্রি থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হলে এটি ৫ দিন পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী থাকে। আর রেফ্রিজারেটরের বাইরে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি মাত্র দুই ঘণ্টা টিকে। প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীন কোভ্যাক্সের কাছে সহজে সংরক্ষণযোগ্য ভ্যাকসিন দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে।
কোভ্যাক্স থেকে ৬ কোটি ডোজের বেশি ভ্যাকসিন পাওয়ার আশ্বাস মিললেও তা কবে নাগাদ হাতে পাওয়া যাবে সেটি অনিশ্চিত বলে জানিয়েছে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
তিনি গত বৃহস্পতিবার একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সবাই বলে টিকা দেবে। কিন্তু কখন দেবে সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলছে না।’ ফলে সরকারের ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কাটা একেবারে সুস্পষ্ট।
এদিকে, ভ্যাকসিন নিয়ে এই অনিশ্চয়তার পেছনে সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন অনেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার প্রথম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ভারত থেকে ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে।
গত বছরের ৫ নভেম্বরে ৩ কোটি ডোজ কিনতে সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে চুক্তি করলেও অর্ধেক ভ্যাকসিন দেওয়ার আগেই রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অথচ সেরাম ইনস্টিটিউটকে প্রাথমিকভাবে দেড় কোটি ডোজের জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছিল বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, দেশে টিকা সংকটের মুহূর্তে চীনের সিনোফার্মা কোম্পানির সঙ্গে ক্রয় চূড়ান্ত করে ফেলেছিল সরকার। কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তা ওই টিকার দাম প্রকাশ করে দেওয়ায় সেটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় আরেকটি চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এমনিতেই করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই টিকাদান কর্মসূচি দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতি আরো বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। তাই এই মুহূর্তে যে করেই হোক, যত দ্রুত সম্ভব টিকা আমদানির বিষয়টি নিশ্চিতের বিকল্প নেই।
সোনালীনিউজ/এমটিআই