ঢাকা : মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে পূরণ করতে হয় এই তিন শর্ত। বাংলাদেশ এই তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ হয়েছে।
তাই প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২১ সালেই দেশ পৌঁছে যাবে অনন্য এক উচ্চতায়।
কিন্তু অর্থনীতি যখন দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ২০২০ সালের শুরুতেই সেই অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করে দেয় করোনা মহামারি।
গত বছরের শেষদিকে মহামারির করোনার প্রকোপ কমে আসার পাশাপাশি ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ টিকা আমদানির লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ফ্রেরুয়ারিতে সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও টিকা আমদানির জন্য তৎপর হয় সরকার।
এসব কারণে থমকে যাওয়া অর্থনীতি আবারো সচল হওয়া নিয়ে আশাবাদী হয় সরকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলসহ সাধারণ মানুষ।
কিন্তু হঠাৎ ভারত সরকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, এরপর অন্যান্য দেশ থেকেও টিকা নিয়ে আশ্বাস পেলেও হাতে না পাওয়া এবং দফা দফায় করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি। সব মিলিয়ে মহামারি প্রতিরোধে এখন টিকাই যেন হয়ে উঠেছে দেশের চালিকাশক্তির নিয়ামক হিসেবে।
ভারত থেকে টিকা না পাওয়া গেলেও টিকা নিয়ে কোনো সংকট হবে না, সরকারের এমন আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যে আশ্বস্ত হয় সব মহল। কিন্তু এখনো পর্যাপ্ত টিকা পাওয়া সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কয়েকটি বক্তব্যে সরকারের হতাশা এবং অনিশ্চয়তার বিষয়টি জোরালোভাবে ফুটে উঠেছে।
গত মঙ্গলবার মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘জি৭ দেশগুলো বলল ১০০ কোটি ডোজ টিকা দেবে। গল্পই শুনতেছি। কিন্তু দেওয়ার নামে তো কোনো আগ্রহ দেখি না। আমি বলি মুলা দেখাচ্ছে সবাই।’ বিভিন্ন দেশ সরকারের টিকা আমদানির উদ্যোগের অগ্রগতি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘সবাই বলে দেবে। কিন্তু হাতে আসছে না।’
এর আগে গত ১০ জুন প্রায় একই কথা বলেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১০ জুন তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজের টিকার ঘাটতি পূরণের জন্য বিভিন্ন দেশকে টিকা পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সবাই টিকা দেবে বলে। কিন্তু হাতে আসছে না।’
সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাত থেকে শিগগির উত্তরণের কোনো পথ দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, অর্থনীতির চাকা সচল করতে হলে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা পাওয়ার বিকল্প নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যেভাবে সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার বাড়ছে, এটি শঙ্কাজনক। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
শুধু আমাদের দেশে নয়, যেসব দেশে রপ্তানি করি, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা যেসব দেশে কাজ করে সেসব দেশেরও সমস্যা আছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর যে অভিঘাত এসেছে তা থেকে তাড়াতাড়ি উত্তরণের সম্ভাবনা দেখছি না। যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন জোগাড় করাই এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাশাপাশি, সবার টিকা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন।’
অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, পর্যাপ্ত টিকা পাওয়া না গেলে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। এজন্য যে-কোনো মূল্যে টিকা সরবরাহের ওপর জোর দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সরকার প্রাথমিকভাবে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১২ কোটি মানুষকে প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।
সে হিসাবে ১২ কোটি লোকের জন্য প্রয়োজন হবে ২৪ কোটি টিকা। আর প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে টিকা দেওয়া হলে ২৪ কোটি টিকা প্রয়োগে লেগে যাবে প্রায় ৭ বছর। এতে দীর্ঘায়িত হবে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসতে। কিন্তু সরকারের প্রতি মাসে ২৫ লাখ টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিয়েই অনিশ্চয়তা রয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, করোনার চ্যালেঞ্জটা বিশাল। এ জায়গাটাতে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল বাজেট বক্তব্যে। কারণ, শুধু ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে দিলেই টিকা এসে যাবে বিষয়টা এমন না।
তিনি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের পলিসির ঘাটতিকে দায়ী করে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এবারের বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব ছিল এবং এ খাতে সরকার কম গুরুত্ব দিয়েছে। কবে নাগাদ টিকা দেওয়া শুরু এবং শেষ করতে পারবে সে ব্যাপারে সরকারের উচিত ছিল একটা টার্গেট ফিক্সড করা। তা না হলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে আছি।
যদি আমরা আগামী বছরের মধ্যে টিকা দেওয়া শেষ করতে না পারি তাহলে এজন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হবে। সেটি অর্থনীতির জন্য ভয়ানক নেতিবাচক। কারণ, দেশে কোনো বিনিয়োগ আসছে না।
সোনালীনিউজ/এমটিআই