থমকে গেছে জীবনের চাকা

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২১, ১১:১৮ পিএম

ঢাকা : রাজধানীর আসমানী পরিবহনের বাসচালক নুরুল ইসলাম থাকেন রাজধানীর বনশ্রীতে। গাড়ি চালান আব্দুল্লাপুর হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে। লকডাউনে আবারো গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ায় কষ্টে দিন কাটছে তার।

তিনি বলেন, আয় না করলে সংসার চালানো কঠিন। বাসের হেলপার সুজনও লকডাউনে কাটাচ্ছেন বেকার জীবন। ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন। অভাবের সংসারে লকডাউনে থমকে গেছে তাদের জীবন চাকা।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটের গণপরিবহনের চালক ও হেলপারদের মতোই সারা দেশের পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র একই। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

দেশের বিভিন্ন জেলার বাসচালক ও হেলপাররা জানান, গত লকডাউনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কিছু সহায়তা দিয়েছিল। এবার সেই অবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। তারা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীতে বাস বন্ধ। তার আগে থেকে আন্তঃজেলা বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জানা যায়, বর্তমানে দেশের সড়ক পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে ৭০ লাখের বেশি শ্রমিকের রুটি-রোজগার জড়িত। কিন্তু করোনার প্রভাবে পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর এসব শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।

শ্রমিকরা বলছেন, তাদের কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন যে অর্থ আদায় করা হয়, সেই টাকার সামান্য অংশও যদি তাদের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে শ্রমিকরা উপকৃত হতো।

মিরপুর ১৪ নম্বরের বাসিন্দা আলিফ পরিবহনের হেলপার পারভেজ বলেন, আমরা দুর্দশার মধ্যে পড়েছি। কাজ হারিয়ে বেকার অবস্থায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। ঘরে খাবার নাই। পকেটে টাকাও নাই। এ অবস্থায় কেউ আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছে না। না মালিকরা, না কোনো শ্রমিক সংগঠন।

ইতিহাস পরিবহনের কন্ট্রাক্টর আলম বলেন, সরকার থেকে যা দেওয়া হয় তা নেতারাই খেয়ে ফেলে। আর মালিকরা তো তাদের স্বার্থ নিয়ে চলে। গাড়ি চললে আয় হবে, না চললে না খেয়ে থাকতে হবে।

তিনি বলেন, গত বছরও গাড়ি বন্ধ ছিল। সরকার থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ফেডারেশনের তহবিলে অনেক টাকা ছিল। কিন্তু আমাদের হাতে এক টাকাও পৌঁছায়নি। এ অবস্থায় আমাদের অর্ধাহারে-অনাহারে কাটাতে হয়েছে।

সূত্র জানায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের বিপুল টাকা থাকলেও কোনো কাজে আসছে না। অন্যদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বিপুল অঙ্কের তহবিলও পরিবহন শ্রমিকদের হাতে পৌঁছায় না। দিনমজুরদের জন্য সরকার ঘোষিত ৭৬০ কোটি টাকার সহায়তাও পরিবহন শ্রমিকরা পাননি বলে অনেকের দাবি।

কয়েকজন শ্রমিক জানান, পরিবহন শ্রমিকদের একটি সংগঠন বিভিন্ন যানবাহন থেকে প্রতিদিন বড় অঙ্কের চাঁদা আদায় করে। শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য সংগঠনটির রয়েছে বিপুল টাকার ফান্ড।

কিন্তু এই টাকা চলমান করোনা পরিস্থিতিতে উপার্জনহীন শ্রমিকদের কোনো কাজেই আসছে না। শ্রমিকরা যখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছেন তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে। এ তহবিল থেকেও অসহায় শ্রমিকরা কোনোরকম সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তারা।

বেশ কয়েকজন চালক ও হেলপার বলেন, লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও কাঁচাবাজার খোলা রয়েছে। গণপরিবহনের চেয়ে সেখানে জনসমাগম কম নয়। বাজার থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা কোনো অংশে কম নয়।

তারা বলেন, সামান্য সঞ্চয় যা ছিল, তা দিয়ে পার করেছি। আগামী দিনগুলো কীভাবে যাবে, তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না। এই দুঃসময়ে কেউ খবরও রাখছেন না।

অবশ্য বিভিন্ন বাস কোম্পানি এই সপ্তাহ থেকে রাজধানীতে ৩২টি বাস কোম্পানির প্রায় তিন হাজার শ্রমিককে সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পর্যায়ক্রমে সাহায্য বণ্টন করবে তারা। ছয় কেজি চাল, এক কেজি ডাল, তেল, ছোলাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্যাকেট সরবরাহ করা হবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বৃহৎ মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকার বাস-মালিক সমিতির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, কঠিন সময় যাচ্ছে। তাই শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে তিন হাজার শ্রমিককে আপৎকালীন সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, শনিবার থেকে প্রতিটি কোম্পানির মাধ্যমে সহায়তার সামগ্রী হস্তান্তর করা হবে। তারাই তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা বণ্টন করবেন। জানা গেছে, সরকার ঘোষিত লকডাউনে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাননি।

রাজধানীর কল্যাণপুর, তোপখানা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, লকডাউন থাকলেও দিনদিনই পুলিশ চেকপোস্ট কমছে। একই সঙ্গে সড়কে কাভার্ডভ্যান, অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও রিকশা চলছে।

প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, বাস বন্ধ থাকায় মালিকদের যেমন সমস্যা, তেমনি শ্রমিকদেরও সমস্যা। আমরা শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। কিছু সহায়তা আমরা দেব।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, শ্রমিকদের কষ্টের বিষয়টি মাথায় রেখে সাহায্য সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অতিদ্রুতই তারা ত্রাণ সহায়তা পাবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই