ঢাকা : ত্রিমুখী অভিযান আর গোয়েন্দা নজরদারিতে শোবিজের মাফিয়া সিন্ডিকেটে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
র্যাব গোয়েন্দা পুলিশ আর মামলার তদারক সংস্থা সিআইডির নজরদারি এবং একের পর এক অভিযানের সিন্ডিকেটের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছে। বিশেষ করে আটককৃতদের সিআইডির দুদিনের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
পরীমনি, পিয়াসা, মৌ ও প্রযোজক রাজ সিন্ডিকেট বানিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। চক্রটির কার কার সঙ্গে বেশি সখ্য এমন একটি সংক্ষিপ্ত তালিকাও তৈরি করেছে সিআইডি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের টার্গেট ছিল উচ্চাভিলাষী উঠতি মডেলরা। এসব মডেলকে ব্যবহার করে প্রভাবশালী ও ধনাঢ্যদের জন্য ফাঁদ পাততেন তিনি। ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থের একটি অংশ পেত এসব উঠতি মডেল।
রাজের ব্ল্যাকমেইল বাণিজ্যের অন্যতম হাতিয়ার ছিলেন তারা। রাজকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার মডেলদের একটি বড় অংশের উত্থান হয়েছে রাজের হাত ধরে। এসব মডেলের অনেকের প্রোফাইল পাওয়া গেছে রাজের ব্যবহূত ডিজিটাল ডিভাইসগুলোয়।
জিজ্ঞাসাবাদে রাজ জানিয়েছেন, মডেলদের মধ্যে একটি অংশ ভালো। তবে আরেকটি অংশ এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকত। মূলত এই অংশকেই টার্গেট করতেন রাজ।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত রাজ ও মিশু হাসানের মোবাইল ও ল্যাপটপে অনেক প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিশেষ মুহূর্তের ছবি/ভিডিও রয়েছে। গোপনে ধারণ করা এসব ছবি দিয়েই চলত ব্ল্যাকমেইল।
এদিকে তরুণ-যুবকদের নিয়ে পিয়াসা রাতভর পার্টি করতে পছন্দ করতেন। এসব পার্টিতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বড় সরকারি চাকরিজীবী ও রাজনীতিকদের সন্তানরা আসত। রাতভর পার্টি থেকে কয়েক লাখ টাকা আয় হতো পিয়াসার। পিয়াসার বারিধারার ফ্ল্যাটে প্রতিদিনই বসত এমন আসর। সন্ধ্যার পর থেকে ওই বাসায় আসত অতিথিরা। শুধু পার্টি করার জন্য কয়েক লাখ টাকা অগ্রিম ও ভাড়া দিয়ে পিয়াসা এই বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। বাসার ভেতরে ছিল দেশি-বিদেশি মাদকের ছড়াছড়ি। পিয়াসার মূল টার্গেট ছিল টাকাওয়ালা ব্যক্তিরা। যাদের টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদে ফেলত পিয়াসা নিজেই। তারপর তাদের আমন্ত্রণ জানাত তার বাসার পার্টিতে।
যারা আসত তাদের নেশায় বুঁদ করে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে অচেতন করত পিয়াসার সহযোগীরা। কখনো কখনো পিয়াসা নিজেই অচেতন ব্যক্তিদের বস্ত্রহীন করে ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণের কাজটি করত। আবার কখনো তার সহযোগী অন্য মডেলদের দিয়ে এই কাজ করাত। ব্ল্যাকমেইল করার মূল অস্ত্রই ছিল তার এসব ছবি-ভিডিও ক্লিপ। অভিযানে পিয়াসার যে চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে সেগুলোতে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির ছবি-ভিডিও ক্লিপ মিলেছে।
সূত্র বলছে, সিআইডি, র্যাব আর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকে আবার বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগও রাখছেন। মূলত পরীমনি, পিয়াসা, মৌ আর রাজের গ্রেপ্তারের আতঙ্ক এখন তাদের মধ্যে।
মহানগর গোয়ন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুনুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা যার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাবো তাকেই গ্রেপ্তার করব। আর র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, কিছু তালিকা ধরে আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি।
এদিকে আলোচিত মামলাগুলোর তদারক সংস্থা সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে থাকা কথিত প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, চিত্রনায়িকা পরীমনি, মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের ব্ল্যাকমেইল কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বিভিন্ন পেশার অনেকের নামই পেয়েছে সংস্থাটি।
সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিআইডি অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।
রোববার (৮ আগস্ট) মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নানা পেশার লোকজনের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য পাচ্ছি। সব ধরনের লোকজনের নামই পেয়েছি। তদন্তের স্বার্থে এগুলো এখনো বলা সম্ভব না। তবে আমরা ভেরিফাই করব তদন্তের মাধ্যমে। জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন মনে হলে আবারো তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করা হবে বলেও জানান তিনি।
সিআইডির তদন্তে আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে এই কর্মকর্তা আবারো বলেন, অপরাধের সাথে জড়িত যে লেভেলের হোক না কেন আইনের আওতায় আনা হবে।
ডিবি কর্মকর্তা সাকলায়েনের সঙ্গে পরীমনির সম্পর্ক কী, এ বিষয়ে সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনি কোনো তথ্য দিয়েছেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক বলেন, আমাদের কাছে যেসব মামলা এসেছে বেশিরভাগই মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত মামলা। মাদকদ্রব্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তদন্তের বিষয়গুলো ঠিক করেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। যদি অন্য কোনো বিষয় থাকে আমরা পরে তদন্তের মাধ্যমে এগুলো নিয়ে আসব।
জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে ওমর ফারুক বলেন, এসব তথ্য তদন্ত করে সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো পাওয়া গেলেই পরবর্তী সময়ে জানানো সম্ভব হবে। কোনো ইনোসেন্ট লোক যেন ভিকটিম না হয় সে ব্যাপারেও কাজ করছি। ব্যাংকের অনেক লোক জড়িত আছে, এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে তবে আসলেই তারা এ ধরনের ঘটনায় সম্পৃক্ত কিনা এ বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখছি।
অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, আবার অসংগতিও পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কী ধরনের অসংগতি পাচ্ছি এ বিষয়টি এখনই তদন্তের স্বার্থে বলা সম্ভব নয়।
নিশ্চিত হয়েই জড়িত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সিআইডির উদ্ধৃতি দিয়ে যেসব ব্যক্তির নাম প্রকাশিত হয়েছে, সেসব নাম সিআইডি থেকে দেওয়া হয়নি। এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কারো নাম আমরা এখনো প্রকাশ করিনি। আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে, অনেক নাম আছে। যাচাই-বাছাই করার পরেই আমরা বলতে পারব।
তিনি বলেন, ব্ল্যাকমেইলের শিকার যারা হয়েছেন-তাদেরও নাম আমরা পেয়েছি তবে তাদের সাথে এখনো আমরা কথা বলতে পারিনি। তাদের সাথে আমরা কথা বলব। তাদের বক্তব্য আমরা নেব। বক্তব্য যাচাই-বাছাই করব। যাচাই-বাছাই করেই পরবর্তীতে বলতে পারব-আরো কারা এসব ঘটনার সাথে জড়িত।
এছাড়া রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিদের বাসায় গতকাল তল্লাশি চালিয়ে ল্যাপটপ এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে দেওয়া হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
সিআইডির একটি সূত্র জানায়, মডেল পিয়াসার সঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড উদ্ধার হয়েছে। একটি লাইফ ইনসিওরেন্সের চেয়ারম্যানের সঙ্গে মডেল মৌয়ের গোপন ভিডিও রয়েছে। পিয়াসার সঙ্গে একজন অলংকার ব্যবসায়ীর বেশ কয়েকটি অডিও রেকর্ড পেয়েছে সিআইডি।
একটি অডিও রেকর্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে এক সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে পরীমনির অডিও রেকর্ডে একটি গাড়ি উপহার দেওয়ার কথা রয়েছে। একই সঙ্গে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরীমনির গভীর সখ্যের বিষয়টি কথোপকথনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সঙ্গেও পরীমনির মোবাইল ফোনে কথা হতো।
সিআইডি কর্মকর্তা আরো জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রেমস বাওয়ানীর সঙ্গে পিয়াসার একটি ক্লাবে সময় কাটানোর ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। গুলশানে একটি দামি ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রির শোরুমের মালিক ইবনুল হাসান খোকনের সঙ্গে পরীমনি ও পিয়াসার বহুবার কথোপকথন হয়েছে মোবাইল ফোনে। গুলশানের এক বারের মালিক রানা শফিউল্লাহর সঙ্গে পিয়াসার লংড্রাইভে যাওয়ার কথোপকথন রয়েছে।
বাংলাদেশে গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিটার সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ ডনের সঙ্গে পিয়াসার হোয়াটসআপে বেশ কয়েকবার কথোপকথন হয়েছে। হাবিবুল্লাহ ডনের মালিকানাধীন গুলশানের গাড়ির শোরুম অটো মিউজিয়ামে চোরাই গাড়ি বিক্রি হয়। মডেল পিয়াসা ওই চোরাই গাড়ি সিন্ডিকেটের সদস্য। অটো মিউজিয়াম থেকে পিয়াসার সহযোগী মিশুর চুরি করা একটি গাড়ি উদ্ধার করেছে র্যাব।
সিআইডির কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল ফোন ও ফেসবুক আইডি তল্লাশি করে প্রভাবশালী ২১ ব্যক্তির সঙ্গে পিয়াসা, পরীমনি ও মৌয়ের যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে। এর বাইরে পিয়াসার মোবাইল ফোনের কললিস্টে বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীর মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। ওই সব ব্যবসায়ীকে পিয়াসা ফোন করে ব্ল্যাকমেইলিং করতেন।
প্রসঙ্গত, ২ আগস্ট রাতে বারিধারা থেকে মডেল পিয়াসাকে এবং মোহম্মদপুর থেকে মৌকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন বসুন্ধরা এলাকা থেকে পিয়াসা-মৌয়ের সহযোগী মিশু ও জিসানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সেদিনই বনানী এলাকার নিজেদের বাড়ি থেকে অভিনেত্রী পরীমনি ও প্রযোজক রাজকেও গ্রেপ্তার করে বাহিনীটি।
এর মধ্যে পরীমনিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
অন্যদেরও মাদক মামলাসহ একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সবগুলো মামলাই তদন্ত করছিল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগ। এর মধ্যে মামলাগুলো অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে হস্তান্তর করেছে ডিএমপি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই