ঢাকা : করোনা মহামারির মধ্যে মশার উপদ্রবে নাকাল রাজধানীবাসী। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগহীনতা ও অব্যবস্থাপনায় বাড়ছে মশাবাহিত রোগ। দুই সিটিই ব্যর্থ কিউলেক্স মশা নিধনে। ফলে রাজধানীর মশার প্রজননস্থল খাল, ডোবা ও নালাগুলো এখন পরিণত হয়েছে মশা উৎপাদনের কারখানায়।
বর্তমানে রাজউকসহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সব মনোযোগ এডিস মশা নিধনে। তাই কোনো গুরুত্ব নেই কিউলেক্সসহ বাংলাদেশে ২৯ প্রজাতির মশার প্রজননস্থলগুলো ধ্বংসের। একই সঙ্গে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোতে নেই কীটতত্ত্ববিদসহ মশা নিধনে শক্তিশালী কমিটি। ফলে যেনতেন করে চলেছে মশক নিধন কার্যক্রম। এতে অন্য প্রজাতির মশার মাধ্যমে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ঢাকায় কিউলেক্স মশা বেড়েছে চারগুণ। পদক্ষেপ না নিলে মার্চ থেকে সামনে ঘনত্ব চরমে পৌঁছাবে। এরপর প্রায় ছয় মাস পার হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশার প্রজননস্থল খাল, ডোবা ও নালাগুলো পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঊর্ধ্বগতিতে। এর মধ্যে কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে না আনলে ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকাসহ মশাবাহিত প্রাণঘাতী ১০টি রোগ সর্বত্র ছাড়িয়ে পড়তে পারে।
রাজধানীর খালগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ না হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাই গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২৬টি খাল বুঝে নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে গণপূর্ত-রাজউক-পাউবোর আরো ১৭টি খাল ও জলাশয় ঢাকা উত্তর সিটি উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পূর্বের খালগুলোই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছে না সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে নতুন করে এসব খাল ও জলাশয় যুক্ত হলে এগুলোও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে না সংস্থা দুটি।
এদিকে গত ২০ আগস্ট ছিল বিশ্ব মশক (মশা) দিবস। ১৯৩০ সাল থেকে প্রতি বছরের এই দিনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এ দিবস উপলক্ষেও রাজধানীতে মশা প্রজননের উৎস জলশায়গুলো পরিষ্কার করা হয়নি। বাংলাদেশে ২৯ প্রজাতির মশা থাকলেও এডিস প্রজাতির মশা দ্বারা সংক্রমিত ডেঙ্গু এ বছর মহামারি আকার ধারণ করেছে।
সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি খাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব খালই ময়লা ও কচুরিপানায় পরিপূর্ণ।
বুধবার (২৫ আগস্ট) সকালে দেখা যায়, রাজধানীর শাহজাহানপুর-খিলগাঁও খালটি কিউলেক্স মশার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনার মধ্যে খালটিতে লাখ-লাখ মশা ও লার্ভা দেখা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, চলতি বছর এ খালটি পরিষ্কার করেনি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। একই অবস্থা দেখা গেছে নন্দীপাড়া ত্রীমোহনী ও রামপুরা খালের মেরাদিয়া অংশ।
মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে এর আগেও নানা অভিনব কর্মসূচি হাতে নিতে দেখা গেছে সিটি করপোরেশনগুলোকে। জলাশয়ে গাপ্পি মাছ, হাঁস, তেলাপিয়া মাছ ইত্যাদি ছেড়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেও দেখা গেছে। যদিও কোনো উদ্যোগ সফল হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
২০১৭ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ঢাকার নর্দমাগুলোতে গাপ্পি মাছের পোনা ছাড়া হয়েছিল। গাপ্পি মাছগুলো এখনো বেঁচে আছে কি না এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য নেই সংস্থাটির কাছে।
পরবর্তীতে ২০২০ সালে ঢাকার তিনটি জলাশয়ে ছাড়া হয়েছিল তেলাপিয়া মাছ এবং হাঁস। হাঁসগুলোর মধ্যে কয়েকটি মারা গেছে।
এরপর সম্প্রতি ঢাকার জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে ডিএসসিসি। এরই মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে দশটি জলাশয়ে হাজার দশেক ব্যাঙের পোনা ছাড়া হয়েছে।
তবে ডিএসসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেছেন, যে তিনটি জলাশয়ে হাঁস ও তেলাপিয়া মাছ ছাড়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে ধানমন্ডি লেক। সেখানে প্রোগ্রেস ভালো। পানিতে লার্ভা এখন অনেক কম, মশার উপদ্রবও কমছে। তবে মশা নিধনের জন্য সংস্থা থেকে সব ধরণের চেষ্টাই করা হচ্ছে।
তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাঙের পোনা সংগ্রহ করা জলাশয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মূল পরিকল্পনা হচ্ছে এই ব্যাঙাচি পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙ হয়ে তারা বংশবিস্তার করবে এবং মশার লার্ভা খেয়ে ক্রমে মশার বিস্তার ঠেকিয়ে দেবে।
২০১৯ সালের জুলাই-আগস্টে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপের পর ২০২০ সালে এ রোগের বাহক এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। তখন আগের ওষুধ বদল করে ম্যালাথিয়ন নামে নতুন ওষুধ আনা হয়। এডিস মশার বিরুদ্ধে এই ওষুধ কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।
কিন্তু এখন কিউলেক্স মশার উপদ্রবে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম। দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সম্প্রতি অভিযোগ করেন, কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে ম্যালাথিয়ন কাজ করছে না। কিন্তু তার এ দাবির পক্ষে বিশেষজ্ঞদের সমর্থন পাওয়া যায়নি।
এদিকে ডিএসসিসিতে মশক নিধনের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি নেই। তবে একটি কমিটি আছে, মশক কার্যক্রমে ব্যবহূত কীটনাশক বাছাই কমিটি।
ছয় সদস্যের এ কমিটিতে আছেন ডিএসসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, একজন কীটতত্ত্ববিদ, একজন কীটনাশক বিশেষজ্ঞ, আইইডিসিআরের একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির একজন ডিপিএম ও সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
সম্প্রতি ওই কমিটির একটি সভা হয়। সেই সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মশা নিধনের জন্য নতুন ওষুধ ডেল্টামেথ্রিনের কার্যকর ডোজ হবে প্রতি লিটার ডিজেলের সঙ্গে ৮ মি. লি.। নিয়মিত কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে ক্র্যাশ কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং সব সময় অঞ্চলভিত্তিক কচুরিপানাপূর্ণ জলাশয় নিয়মিত পরিষ্কার করা। কিন্তু এগুলোর কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
একই ভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) খাল ও জলাশয়গুলো মশার প্রজনন কেন্দ্র। ডিএনসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, আমাদের মশক নিধন কর্মসূচি চলমান। আমরা ফেব্রুয়ারির শুরুতেই কর্মসূচি নিয়েছি, আবার দেশের বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি।
কর্মসূচি চলমান থাকলে মশা কেন কমে না প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেন, ঢাকনা খোলার ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের বেশ কিছু রাস্তার পাশের ড্রেনে ওষুধ ছিটানো সম্ভব হয়নি। সেই সাথে আফতাবনগর, বসুন্ধরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ও প্রাতিষ্ঠানিক জোনের মশক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের নিজেদের ওপর বর্তায়। সেসব এলাকায় মশার প্রাদুর্ভাব বেশি। আমরা সেইসব কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছি।
অন্যদিকে ডিএনসিসি’র কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, আমি নামেমাত্র তাদের পরামর্শক। যা বলে আসি কিছুই করে না। আমি ঠিক করেছি ওদের ডাকে আর সাড়া দেব না। প্রতিবার গিয়ে করণীয় ঠিক করে দিয়ে আসি, একটা কাজও ঠিকমতো করে না।
মেয়রের আন্তরিকতা আছে, কিন্তু মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগ কোনো কাজ ঠিকমতো করে না। কিউলেক্স মশা নিয়ে কতবার করে বললাম, যেন খালগুলো কচুরিপানামুক্ত করে। কে শোনে কার কথা। তাদের অবহেলার কারণে নগরবাসীর সাথে আমি ও আমার পরিবারও মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর জানান, এই অঞ্চলের ট্রপিক্যাল কান্ট্রিগুলোতে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আর সে কারণে বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। ম্যালেরিয়া এবং ফাইলেরিয়া এখন আর সারা দেশে নেই। ফাইলেরিয়া উত্তরাঞ্চল এবং ম্যালেরিয়া পাহাড়ি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর ডেঙ্গুর ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে ঢাকাতেই দেখা যাচ্ছে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা। যে মশা ঘর-বাড়িতে হয়, সেটা তো বাসিন্দাদেরই খেয়াল রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, মশাবাহিত রোগের চিকিৎসার কোনো সমস্যা নাই। বাংলাদেশে মশাবাহিত সব ধরনের রোগেরই চিকিৎসা আছে। কিন্তু চিকিৎসার চেয়ে জরুরি হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। সেটা সবাই মিলে করতে হবে। মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বন্ধ করতে হবে। এ জন্য ঢাকায় সিটি করপোরেশন এবং ঢাকার বাইরে পৌরসভা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে।
তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমরা মশা মারার নামে যেসব কেমিক্যাল, স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করছি, তা জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন ক্ষতি ডেকে আনতে পার। তাই আমাদের উচিত হবে প্রাকৃতিক উপায়ে মশার জন্মরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে আনা।
এদিকে বুধবার (২৫ আগস্ট) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা না গুনে ৫০ টাকার কেরোসিন কিনে নিজের বাসা-বাড়ি ও নির্মাণাধীন ভবনের এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করেন।
সচিবালয়ে সারাদেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ, দপ্তর/সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার ১১তম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মেয়র এ আহ্বান জানান।
ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের চিহ্নিত হটস্পটগুলো আগে-ভাগে নির্ধারণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিও আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, এটা আগে করতে পারলে আমরা অন্যভাবে পরিকল্পনা করতে পারি। সারা বছর কীভাবে ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট করতে পারি সেই পরিকল্পনা আমরা করেছি। সবাইকে বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে।
সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে চলছি। যদি ২০১৯ সালকে নির্ণায়ক হিসেবে ধরি, সেখানে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে যেটা পেয়েছি, সেটা যাতে কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই পর্যায়ে যেন ঢাকাবাসীর ভোগান্তি না হয়, সেই লক্ষ্যেই আমরা সর্বাত্মক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই