ঢাকা : এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রেলের উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও বাড়েনি যাত্রীসেবার মান। বরং নিম্নমুখী যাত্রীসেবার সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে ট্রেনে ছিনতাইকারী ও ঢিল আতঙ্ক।
জানা গেছে, রেলের বিনিয়োগকৃত অর্থের সিংহভাগই ব্যয় হয়েছে রেলপথ সংস্কার, ইঞ্জিন ক্রয় ও মেরামত, নতুন বগি ক্রয় ও মেরামত কাজে।
তবে এসব কাজে কিছু রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে।
এসব কারণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেও রেল কর্তৃপক্ষ একদিকে যেমন অর্জন করতে পারেনি যাত্রী সন্তুষ্টি, অন্যদিকে বছরের পর বছর লোকসান গুনে যাচ্ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি।
রেলের উন্নয়নে গত এক দশকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৬৭ কোটি ৮১ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে রেলের ৩৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।
তবে অভিযোগ আছে, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রেলের এসব উন্নয়ন প্রকল্প চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এর মধ্যে যমুনা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে। খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। সব সিঙ্গেল লাইনকে পর্যায়ক্রমে ডাবল লাইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। নতুন নতুন ব্রিজ করা হচ্ছে।
দেশের যেসব এলাকায় রেল সংযোগ নেই, সেখানে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ চালু করা হবে-পর্যায়ক্রমে দার্জিলিংয়ের সঙ্গেও কক্সবাজারে রেল সংযোগ স্থাপন করা হবে।
রাঙামাটির কাপ্তাইকে রেলপথের সাথে সংযুক্তকরণে ৪২ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে রেলওয়ে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।
কৃষকদের সহজেই ট্রেনে কৃষিপণ্য সরবরাহ সুবিধার্থে সারা দেশে কৃষিপণ্য পরিবহনে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনতে যাচ্ছে রেল মন্ত্রণালয়।
টিকিট ছাড়া বিনা প্রয়োজনে কেউ যেন বিভিন্ন স্টেশনে ঢুকতে না পারে সে জন্য একসেস কন্ট্রোল সিস্টেম শুরু করেছে রেলওয়ে। পাশাপাশি যেসব রেললাইনের ওপর মানুষের বেশি চলাচল সেসব এলাকার দুপাশে ফেন্সিং দিয়ে ঘেরাও করে দেওয়া হচ্ছে।
তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে এসব খাতে বিপুল বিনিয়োগে হলেও সে তুলনায় যাত্রীসেবা খুবই কম।
তাদের মতে, যাত্রীসেবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত না হলে রেলপথ বাড়িয়ে, ট্রেন বাড়িয়ে কোনো সুফল মিলবে না। রেলপথ ও রেলসেতু নির্মাণ ছাড়াও যাত্রীসেবা বাড়িয়ে রেলকে বদলে দিতে হবে।
এ ছাড়া বিপুল বিনিয়োগ হলেও ট্রেনে গতি না আসায় নিশ্চিত করা যাচ্ছে না যাত্রী সেবাটি।
কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর রেল স্টেশন পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার পেরোতেই লাগে প্রায় আধ ঘণ্টা। তার ওপর এখন ৬৮ শতাংশ রেল ইঞ্জিনের আয়ুও নেই। ট্রেন চলার সময় লাইন থেকে পড়ে যায় ইঞ্জিন। ইঞ্জিন বিকল হয়ে বা রেলপথে ত্রুটির ফলে ট্রেনের চাকা পড়ে যায়।
জানা যায়, রেলে বর্তমানে ইঞ্জিন রয়েছে ২৭৮টি যার বেশির ভাগেরই বয়স ৩৫ থেকে ৬৩ বছর। এরমধ্যে ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৭৭ শতাংশ কোচের (বগি) আয়ুষ্কাল শেষ। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন ও কোচ রেলে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর ২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ডেমুর আয়ুষ্কাল শেষ না হতেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে অধিকাংশ ট্রেনেরই বিরতি স্থান বেশি। রাজনৈতিক কারণে বিরতির স্থান বাড়াতে হচ্ছে বিভিন্ন রেলপথে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ট্রেনের গতি বাড়ানোর কথা বলা হলেও তাও বাড়ানো যাচ্ছে না।
আবার বিরতির স্থান বেশি থাকার কারনে বিনা টিকেটে যাত্রীরা ট্রেনে উঠে টিকেটধারী যাত্রীদের বিড়ম্বনায় ফেলেন।
কিন্তু এ নিয়ে ট্রেনে যাত্রী সেবায় নিয়োজিত এটেন্ডডেন্টরা কোন ভূমিকা পালন করে না। তারা বরং বিনা টিকিটের যাত্রীদেও কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের দিকে মনোযোগী থাকেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রেলে একটার পর একটা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীসেবা যেমন বাড়েনি, আবার লোকসানও কমেনি। প্রকল্প ঘিরে চলছে লুটপাট।
প্রকল্পের শুরুতে যেমন অবাস্তব ব্যয় ধরা হচ্ছে, বিলম্বে বাস্তবায়ন করে ব্যয় বহুগুণ বাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে বেশ কয়েকটি বছর ধরে নিরাপদ বাহন হিসেবে খ্যাত রেল হয়ে পড়েছে আতঙ্কেও কবাহন হিসেবে।
চলন্ড ট্রেনে ঢিল ছোড়া, ট্রেনের ভেতর ও ছাদে ছিনতাই, টান দিয়ে যাত্রীদের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার মত ঘটনাগুলো আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে রেল যাত্রীদের মধ্যে। গত বছর রেল মন্ত্রণালয় থেকে একটা হিসাব প্রকাশ করা হয়েছিল।
সেখানে বলা হয়েছে, শুধু পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় গত পাঁচ বছরে ট্রেনের ২ হাজারের বেশি জানালা-দরজা ভেঙেছে। এসব জানালা-দরজা মেরামতে বছরে পৌনে দুই কোটি খরচ হচ্ছে।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ২০ জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৫টি জেলা রয়েছে। ২০ জেলার মধ্যে ৭০টি স্পটকে স্টোন থ্রোয়িং স্পট হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব স্পটে সবচেয়ে বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া চলাচলকারী ট্রেনগুলোর ভেতরের অবস্থা অস্বাস্থ্যকর। পাশাপাশি ট্রেনের অনেক বগিতেই সিট, দরজা, জানালাও ভাঙা। ঈদেও সময় আসনের চেয়ে দেয়া হয় বেশি টিকিট। ফলে টিকিট কেটেও অনেক সময় বসার আসন পাওয়া যায় না। আর বেশিরভাগ সময়ই ট্রেন ছাড়তে দেরি করে। ফলে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। ট্রেনের খাবার-দাবার নিম্ন মানের। দাম রাখা হয় অনেক বেশি।
ঢাকা-ব্রাক্ষণবাড়িয়া রুটে নিয়মতি চরাচলকারী সায়েম হোসেন নামে এক ট্রেন যাত্রী জানান, বাইরে থেকে ট্রেনে পাথর ছোড়া, ট্রেনের লাইনের নাট বোল্ট খুলে যাওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, বগি খুলে যাওয়ার মতো ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হতে হয় আমাদের। ঠিক সময় গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে পারে না।
তার মতে, কোরবানীর ঈদের মতো উৎসবের সময় ট্রেনে কোনো নিয়মই মানা হয় না। যত সিট তার কয়েকগুণ বেশি টিকেট দিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যান কেউ কেউ। আর ভিতরে পুরো আলুরদম অবস্থা।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রেলের দুর্নীতির যে ১০টি উৎস চিহ্নিত করে তার মধ্যে তিনটি হলো রেলের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রিতে ব্যাপক কালোবাজারি, যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দেওয়া এবং ট্রেনে নিম্নমানের খাবার দিয়ে বেশি দাম নেওয়া।
রেলের যাত্রী সেবার বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিদেবদন বলা হয়েছে, অতিরিক্ত হকারের চাপ, পকেটমারদের দৌরাত্ম, খাবার গাড়ি নিয়ে সিন্ডিকেট, টিকিট কালোবাজারি, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, পুরোনো বগি দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাত্রী সেবাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তা ছাড়া ছেড়ে যাওয়ার পর ট্রেনের ইঞ্জিন প্রায়ই বিকল হয়ে যায়।
সোনালীনিউজ/এমটিআই