ঢাকা : একের পর এক চমক দেখিয়েই চলছে করোনাভাইরাস। এ মহামারি শুরু হওয়ার দেড় বছর পর বিশ্বজুড়ে এখন নতুন করে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় উদ্ভূত করোনাভাইরাসের নতুন প্রকরণ ওমিক্রন। এরই মধ্যে নতুন এ প্রকরণটি ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের পাঁচ রাজ্যসহ বিশ্বের ৫৭টি দেশে।
শনিবার (১১ ডিসেম্বর) দুজন রোগীর দেহে ওমিক্রনের সন্ধান পাওয়ায় দেশে এবার নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা মহামারি আমাদের জীবনকে অবর্ণনীয় হুমকির মুখে ফেলেছে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশ কঠোর পদক্ষেপ নিলেও, দেশে এটি প্রতিরোধে ও সংক্রমণ মোকাবিলায় বাড়তি কোনো প্রস্তুতি নেই।
তাছাড়া এখন পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৩ শতাংশ নাগরিক দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। তার মধ্যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। আর ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তাই ওমিক্রন প্রতিরোধে এ ধরনের অবহেলায় পরবর্তীতে এটি আরো ক্ষতিকর মহামারিতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকার শিশু হাসপাতালে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে প্রথম ওমিক্রনের রোগী ধরা পড়ার কথা জানান। তারা দুজনই বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটার। তারা আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে সফর করে সম্প্রতি দেশে ফিরে আইসোলেশনে রয়েছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যে দুজন নারী ক্রিকেটারের শরীরে ওমিক্রন ভাইরাস পাওয়া গেছে, তাদের আমরা কোয়ারেন্টাইনে রেখেছি এবং তারা সুস্থ আছেন।
তাদের যা যা চিকিৎসা দরকার, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝে মাঝেই তাদের পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। পুরোপুরি সেরে উঠতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। দুই সপ্তাহ আমরা দেখব, সম্পূর্ণ সেরে উঠলে তখন তাদের আমরা ছাড়তে পারব। এ ছাড়া দুই নারী ক্রিকেটারের সঙ্গে যারা যারা ছিল, তাদের সবার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে ওমিক্রনের প্রথম রোগী ধরা পড়েছিল, সেখানকার এক চিকিৎসক জানিয়েছিলেন এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের উপসর্গ মৃদু। আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনও পড়ছে না। তা ছাড়া ভারতের ৫ রাজ্যে ওমিক্রন আক্রান্ত ৩২, লক্ষণ ‘মৃদু’। আর ওমিক্রনে বিশ্বে এখন অবধি কারো মৃত্যুর নিশ্চিত খবরও পাওয়া যায়নি। তাই এটি নিয়ে এখনো বড় কোনো উদ্বেগের কারণ নেই।
অন্যদিকে ভবিষ্যতের মহামারিগুলোর ভয়াবহতা বর্তমানের কোভিড পরিস্থিতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকার অন্যতম রূপকার অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাহ গিলবার্ট পরবর্তী মহামারিগুলো মোকাবিলায় এ খাতে অধিক আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছেন।
ওমিক্রন বিষয়ে তিনি সতর্ক করে বলেন, করোনা ভ্যাকসিন নতুন এ ধরন প্রতিরোধে সীমিত কার্যকর হতে পারে। যেহেতু নতুন ধরনটির সম্পর্কে বেশি তথ্য জানার সুযোগ হয়নি, একারণে সর্তকতা অবলম্বনের বিকল্প নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও/হু) তথ্যমতে, এরই মধ্যে বিশ্বের ৫৭টি দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন দেশে বাড়ছে এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার।
এক প্রতিবেদনে হু’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যদিও এখন পর্যন্ত ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রন সংক্রমণের হার কম।
কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছেয, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে যেভাবে এই ধরনটি ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে করোনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার সামনের দিনগুলোতে অনেক বাড়বে। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাঁচ রাজ্যে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া পাওয়া গেছে। গত ২ ডিসেম্বর ভারতে ওমিক্রন সংক্রমিত প্রথম রোগী ধরা পড়ে। গতকাল পর্যন্ত এ ১০ দিনের মধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩২ জনে পৌঁছেছে। ওমিক্রন সংক্রমিত সবচেয়ে বেশি ১৭ জন রোগী ধরা পড়েছে মহারাষ্ট্র রাজ্যে। এরপর সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে রাজস্থানে, নয়জন। গুজরাট রাজ্যে তিনজন, কর্নাটকে দুজন, দিল্লিতে একজন রোগী ধরা পড়েছে। মহারাষ্ট্রে আক্রান্তদের মধ্যে দুটি শিশুও রয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের টিকা নিলে সেটা কোভিডের সুরক্ষায় বেশি কার্যকার হবে বলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাইজার বায়োএনটেক বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুইটি করে ডোজে কোভিড-১৯ সুরক্ষায় বেশি কাজ করার থেকে দুইটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের টিকার সংমিশ্রণে মানুষের শরীরে কোভিডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে।
এই গবেষণায় আরও জানা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার এর টিকা প্রথম ডোজ হিসেবে নেয়ার নয় সপ্তাহ পর যদি দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে মর্ডানার টিকা গ্রহণ করে তা একজন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বেশি কার্যকার হবে।
গবেষণায় ১ হাজার ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবীর দেহে ফাইজারের প্রথম ডোজ দেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে মর্ডানার টিকা প্রয়োগ করার পর সেটার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টিকার প্রয়োগে কোন প্রকারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেয় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
যুক্তরাজ্যের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রফেসর জোনাথন ভ্যান-ট্যাম বলেছেন, টিকার সংমিশ্রণ হয়তো আমাদের বুস্টার কর্মসূচিকে আরো সহজ করবে। বিশেষ করে যেসব দেশে টিকার সংকট রয়েছে অথবা তাদের টিকাদান কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করতে চান, তাদের জন্য এটি সহায়ক হবে।
অন্যদিকে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ঠেকাতে প্রচলিত টিকার দুই ডোজ যথেষ্ট না বলে জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা।
শুক্রবার যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা এই সতর্কতার কথা জানিয়েছেন। তবে তৃতীয় ডোজ অর্থাৎ বুস্টার ডোজ ধরনটির বিরুদ্ধে সুরক্ষার হার প্রায় ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
যুক্তরাজ্যের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি ‘ইউকেএইচএসএ’ বলছে, সুরক্ষা কম দিলেও ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার পর করোনার টিকা হাসপাতালে ভর্তি ঠেকাতে সক্ষম।
ওমিক্রনের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা যাচাই করতে ধরনটিতে আক্রান্ত ৫৮১ জন এবং ডেলটায় আক্রান্ত কয়েক হাজার জনকে নিয়ে গবেষণা চালান যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা। সেখানে দেখা যায়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা কমে এসেছে।
ফাইজারের টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার পর সুরক্ষার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে দেখা যায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, টিকাগুলোর তৃতীয় ডোজ নিলে করোনার বিরুদ্ধে সুরক্ষার হার বেড়ে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশে দাঁড়ায়।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এসএম আলমগীর বলেন, অফ্রিকা ফেরত দুই খেলোয়াড় করোনা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ায় এক ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ ওমিক্রন দ্রুত ছড়ায়। যদিও এতে মারাত্মক কিছু পাওয়া যায়নি। তবুও একে অবহেলা করা যাবে না।
তিনি বলেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ মাত্রা ডেল্টার চাইতে বেশি, এমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তাই ওমিক্রনকে ঘিরে বুস্টার ডোজ তড়িঘড়ি করে না দিয়ে আগের দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ ভ্যাকসিনের আওতায় আনার আনার পরামর্শ তাঁর। একই সঙ্গে সকলকে স্বাস্থ্য বিধি মানার আহ্বান করেন এ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী
এ মহামারি মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতির অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।
তিনি বলেন, ওমিক্রনকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। একটি পরামর্শক কমিটি অবিলম্বে গঠন করা উচিত। করোনা ভাইরাসের যে সব প্রকরণ তাড়াতাড়ি ছড়ায় সেগুলো আমাদের জন্য বিশেষ করে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। এগুলোকে যদি আগে থেকেই চিহ্নিত করা যায় তাহলে নিরাময় সম্ভব।
তিনি বলেন, প্রথমত দেখতে হবে এই ভ্যারিয়েন্টটি টিকা প্রতিরোধ করে কিনা। আরেকটি হলো, এর কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হবে কিনা।
এছাড়া বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরে আগে ভাগেই সতর্কতা বাড়াতে হবে। আর যারা আক্রান্ত দেশ থেকে আসবে তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে টেস্ট করতে হবে। মহামারি বিষয়ে আমরা যে জ্ঞান এবং অগ্রগতি অর্জন করেছি এটিকে হারাতে দেয়া যাবে না।
আইইডিসিআরের অন্যতম পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, করোনা ভাইরাসের নুতন ধরনের সংক্রামণ প্রতিরোধে তুলনা মূলক বাংলাদেশে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ভ্যারিয়েন্টটি মোকাবিলায় বিধিনিষেধের ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা ছাড়া তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জনসাধারণও দ্রুত সংক্রমণশীল ভাইরাসটিকে আমলে নিচ্ছে না। তাই কেউ স্বাস্থ্য বিধিও মানছে না। এরমধ্যে দেশে ওমিক্রন রোগী সনাক্ত হওয়ায় আরো উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে তাদের অবশ্যই জিনোম সিকোয়েন্স করতে হবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে আসলে তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে টিকা মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ কার্যকর। এ কারণে অনেক বেশি লোককে টিকা দিতে হবে। তাহলেই বেশি সংখ্যক মানুষকে সুরক্ষিত রাখা যাবে।
ওমিক্রনের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, এ নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যা যা প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব, ইতোমধ্যে তার সবই নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া চলতি মাসের মধ্যেই দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনতে কাজ করা হচ্ছে।
অবশ্য সেসব প্রস্তুতির বিষয়ে যতদূর জানা গেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো- ঢাকায় যেসব হাসপাতালে আগে কোভিড চিকিৎসা হয়েছে, সেগুলোকে নতুন করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এছাড়াও সাউথ আফ্রিকা-সহ ওমিক্রন আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে আসলে তাকে ৪৮ ঘণ্টা আগে বাধ্যতামূলক করোনা টেস্ট করে আসতে হবে। এরপর তাকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। পাশাপাশি স্থালবন্দর ও সীমান্তে করোনা পরীক্ষায় জোরদার দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ করা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ২৩ শতাংশ নাগরিক।
সোনালীনিউজ/এমটিআই