বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএমএ কুদ্দুস । ১৯৭১ সালে ১৭-১৮ বছরের তরতাজা কিশোর ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুবই শান্ত এবং নরম মনের মানুষ। আ. কুদ্দুসের ছেলে মাসুম বিল্লাহর মতে তিনি একজন সদালাপী মানুষ। সকলের সঙ্গে হাসিখুশি থাকতে এবং কথা বলতে পছন্দ করেন। ১৯৭১ সালের ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ উত্তাল হয় এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
২৫ মার্চ কাল রাতে পাক-হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্র বাঙ্গালীর উপর। পিলখানা, বিডিআর হেট কোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস’সহ বিভিন্ন স্থানে গুলি চালিয়ে হত্যা করে হাজার হাজার বাঙ্গালী। তখনি প্রতিরোধ গড়ে তোলে বিডিয়ার, পুলিশ, ছাত্র জনতা। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের ৫০ উপলক্ষে সোনালীনিউজ কথা বলেছে মুক্তিযোদ্ধা এসএমএ কুদ্দুসের সঙ্গে। চলুন জানা যাক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা।
সোনালীনিউজ : ছোটবেলার দুরন্তপনায় বাবা-মাকে খুব জ্বালাতন করতেন নাকি শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন -
এসএমএ কুদ্দুস : আমি একেবারেই দুরন্ত ছিলাম না খুবই শান্ত প্রকৃতির ছিলাম। আপনাকে একটি গল্প বলি, তখন আমার বয়স বারো বা তেরো বছর। এই সময় বাগেরহাটের চিতলমারী থানার বড়বাড়িয়ার একটি হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ছিলাম। আমাদের বাড়ি যেহেতু বাগেরহাট সদরে সেই হিসেবে অনেক দূর। আমি সেখানে বেশিদিন পড়তে পরিনি। বাড়ি এবং মার কথা বেশি মনে করে কান্নাকাটি করতাম। তারপর সেখান থেকে আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
সোনালীনিউজ : ১৯৭১ সালে আপনি কিশোর ছিলেন, সে সময়ে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে আপনার ভেতর হলো কি করে -
এসএমএ কুদ্দুস : রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ সরাসরি না শুনলেও রেডিওতে শুনেছি। তখন তো আর সকলের কাছে রেডিও থাকতো না। গ্রামের দু’একজনের কাছে থাকতো। ভাষণ শুনতে শুনতে দেখি শহর থেকে গ্রামের দিকে অনেক লোক চলে আসছে। তাদের মুখে ঢাকার ঘটনা শুনেছি। মানুষ মারছে পাকিস্থানি মেলেটারিরা, আগুন দিচ্ছে ঘরে ঘরে।
কিছুদিন যেতেই বাগেরহাট সদর উপজেলার গোটাপাড়া ইউনিয়নের কান্দাপাড়ায় রাজাকার-হানাদার বাহিনী আসে। একদিন রাতে ২০/২২ জন লোককে তাদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। এই দৃশ্য আমি সরিষা খেতে বসে দেখি। তখন আমরা রাতে রাজাকার-হানাদার বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে থাকতাম। রাতের আধারে এই হত্যার দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। তখন থেকে মনের ভেতর জেদ কাজ করতো, আমি এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো। এই ঘটনার কিছু দিনের ভেতর যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ইন্ডিয়া যাই।
সোনালীনিউজ : প্রশিক্ষণের জন্য ইন্ডিয়া যাওয়ার সময়ের গল্পটি শুনতে চাই -
এসএমএ কুদ্দুস : আমরা শত শত মানুষ মুক্তিযোদ্ধায় অংশ নেওয়ার জন্য যশোরের ইতনা ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখন সকলে মিলে একটি নৌকা ঠিক করি। তার সঙ্গে চুক্তি হয় ইতনা ক্যাম্প পার করে দেওয়ার জন্য কিন্তু যে নৌকাটি ঠিক করি সে নৌকার মাঝি রাজাকার-মিলিটারি নিয়ে এসে আমাদেরকে ধরিয়ে দেয়। তখন তো অনেকে উদ্ভাস্ত হয়ে দেশ ছাড়ছে। আমরাও তাদের মতো ছিলাম।
তখন রাজাকার-মিলিটারির সবার টাকা-পয়সা নিয়ে যায়। কিন্তু আমার টাকা নিতে পারেনি। আমার টাকা দিয়ে ৫-৭ জন মারুফ, আহম্মাদ, সবুর, রুস্ত ‘সহ আরও কয়েকজন সন্ধ্যার দিকে বাগদা বর্ডার দিয়ে ভারতের টেটরা ক্যাম্পে পৌছাই। ওখানে কিছুদিন থাকার পর আমাদেরকে পিপা ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
সোনালীনিউজ : কোথায় গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং করেছিলেন এবং সম্মুখ যুদ্ধের একটি ঘটনা আমরা শুনতে চাই -
এসএমএ কুদ্দুস : গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং করেছিলাম প্রথমে ইন্ডিয়ার পিপা ক্যাম্পে। তারপর উচ্চ পর্যায়ের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য বিহারে যাই। সেখানে ২৮ দিনের ট্রেনিং শেষ করে পিপা ক্যাম্পে আসি আবার। পিপা ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝে গভীর আমরা সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছি।
এই সময়ের একটি ঘটনা বলি, এক দিন আমরা ৭/৮ জন সাতক্ষীরার মৌতলা কাজীবাড়ির সামনে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ চলাকালে দেখি ৩-৪ জনকে আশেপাশে কোথাও নাই। তখন বাকি যারা ছিলাম, তারা যুদ্ধ করতে থাকি। সে দিন ভেবে ছিলাম আর বেঁচে ফিরতে পারবো না। কারণ, আমরা যারা ছিলাম তাদের ভেতর একজনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বাকি আমার দু’জন ছিলাম তবে পিছপা হয়নি। বিভিন্ন কৌশলে যুদ্ধ করে সেখান থেকে বের হয়ে আছি। এই ঘটনা এখনও মনে হলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। তার দু’দিন পর পিপা ক্যাম্পের মধু ভায়ের নির্দেশে আমরা ১০ জন ভারত থেকে বাংলাদেশে আসি এবং বাগেরহাটের তাজুল ইসলাম সাহেবের দলে যোগদি।
সোনালীনিউজ : বিজয়ের পঞ্চাশে এসে ৭১’-এর ১৬ ডিসেম্বরের কথা মনে আছে আপনার -
এসএমএ কুদ্দুস : মনে থাকবে না আবার। তখন যেদিকে তাকাই সে দিকেই যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ। নদীতে ভেসে যাচ্ছে মৃত্যু লাশ। শুধু হাহাকার আর হাহাকার তবুও যুদ্ধ শেষ করে ফিরে আসা আমরা সকলে ১৬ ডিসেম্বর বিকার ৪টায় বাগেরহাটে একটি আনন্দ মিছিল বের করি। সেই সময়ের অনুভূতি কথায় বা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সোনালীনিউজ : এই সময়ে এসে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যখন দেখেন মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে তখন কি মনে হয় নিজের কাছে -
এসএমএ কুদ্দুস : একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এই ধরণের ঘটনা দেখলে মনে হয় আত্মহত্যা করি। কারণ, যখন আমরা পিপা ক্যাম্পে ট্রেনিং করি তখন মাজার নিচ সমান কাদার ভিতর দিয়ে গিয়ে দুপুরের ভাত প্লেটে এনে খেতে হতো। ট্রেনিং শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত আমাদের অবস্থা। এর ভেতর ক্যাম্পে প্রচুর মানুষ। যে সময় মতো যেতে পেরেছে সে খেয়েছে আর যে সময় মতো পৌঁছাতে পারেনি সে খেতে পারেনি। খালি পেটে আবার ট্রেনিং শুরু করতে হয়েছে। শুধু একটার কথা বললাম, আরও হাজার কষ্ট আছে।
এত কষ্ট করার পরেও এই অনিয়ম মেনে নেওয়া যায় না। অথচ দেখুন অনেক প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ এখন পর্যন্ত ভাতা বা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না।
সোনালীনিউজ : শেষ প্রশ্ন নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতে চান -
এসএমএ কুদ্দুস : দেখুন ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিলো ১৭-১৮ বছর। এই সময়ের ১৭-১৮ বছরের নতুন প্রজন্ম এবং শুধু ১৭-১৮ নয় সকলকে বলতে চাই। দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসুন।