ঢাকা : নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিদেশ কূটনীতিকদের সুনির্দিষ্ট আইন তৈরির দাবি দীর্ঘ দিনের। তারপরও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই সিইসি ও কমিশনার নিয়োগের আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই সার্চ কমিটি চলতি সপ্তাহে গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। কমিটিতে কারা থাকবে তা এখনো ঠিক হয়নি।
নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইনের কথা সংবিধানে থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সেটা প্রণয়ন করতে পারেনি কোনো সরকার। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রায় সব দলই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে। এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছিল বিদেশি কূটনীতিকরাও।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়ে বিগত ২০ ডিসেম্বর থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে এখন পর্যন্ত অংশ নেয় জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ সহ ২৪টি দল। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপ করে সোমবার (১৭ জানুয়ারি)। এর ম্যধ্যমেই ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ শেষ হয়।
বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, এলডিপিসহ বেশ কয়েকটি দল এই সংলাপে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এর আগেই নতুন ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন রাষ্ট্রপতি।
বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ইসি গঠনে সুনির্দিষ্ট আইনের দাবি জানায়।
সংলাপে সার্চ কমিটি গঠনের বিরোধিতা এসেছে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাছ থেকে।
সংলাপে সার্চ কমিটির বিকল্প প্রস্তাবের পাশাপাশি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের কথাও বলেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
গণতন্ত্রী পার্টি সার্চ কমিটির পাশাপাশি একটি ‘বিশেষ কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছে- প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে নিয়ে ওই কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে।
এমনকি গত রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠিত এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে ইসি গঠনে দ্রুত আইন করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।
এ সময় কূটনীতিকরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন।
এদিকে সোমবার (১৭ জানুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানান— সিইসি ও কমিশনার নিয়োগের জন্য একটি সার্চ কমিটি করা হবে। ছয় সদস্যের এই কমিটির প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি।
এছাড়া সদস্য হিসেবে থাকবেন হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। এই সার্চ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করলে সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংবিধানের ১১৮(১)-এ বিধান আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনটি নিয়ে আসা হয়েছে। খুব বেশি বড় আইন না এটি। প্রস্তাবিত আইনে এ পদগুলোর নিয়োগে কিছু শর্ত রাখা হয়েছে। কমপক্ষে ৫০ বছর বয়স এবং সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচারবিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা ন্যূনতম শর্ত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অযোগ্যতার কথাও বলা হয়েছে খসড়ায়। দেউলিয়া হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, নৈতিক স্খলন বা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হওয়া এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই আইনের অধীনেই হচ্ছে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন— আশা করা যায়, এই আইনটি চূড়ান্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভেটিং শেষে সংসদে পেশ হলে নতুন কমিশন এই আইনের আওতায় হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হাতে। সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে তা গঠনের কথা থাকলেও তা এখনো প্রণীত হয়নি।
২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন। প্রথমবার সার্চ কমিটিতে একজন নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি।
আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে প্রথমবার গঠিত সার্চ কমিটিতে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) পদধারী ওই কমিটিতে ছিলেন। দ্বিতীয় বার গঠিত সার্চ কমিটিতে উপরোক্ত চারজনের পাশাপাশি অতিরিক্ত দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীন আখতার। দুবার গঠিত সার্চ কমিটির দুবারই প্রধান ছিলেন তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি ও সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমাদের আশা ছিল, ইসি গঠেনে আইনসহ রাষ্ট্রপতি আমাদের দাবিগুলো বিবেচনা করবেন।
দেশে নির্বাচন নিয়ে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের কাজ নিয়ে। সেটা দূর করার একটিই সমাধান, তা হলো সংবিধানের আলোকে ইসি গঠনে একটি স্থায়ী আইন করা।
তিনি বলেন, আইনটি হলে রাষ্ট্রপতি যে সংলাপ করেন, তা প্রতি পাঁচ বছর পরপর করার দরকার পড়ে না। সবার মতামত নিয়ে যদি আইন করা হয় তবেই একটি স্থায়ী সমাধানে আসতে পারত।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ইসি গঠনে পৃথক আইন হলে অবশ্যই ভালো হতো। তবে যারাই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে সবাই বিভিন্ন দাবি করেছে, কিন্তু সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে কেউ আপত্তি করেনি। এখন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি কী পরামর্শ দেবে সেটা দেখার বিষয়।
তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি এমপি বলেন, সংলাপে ইসি গঠনে সুনির্দিষ্ট আইনের প্রস্তাব আমারা দিয়েছিলাম।
রাষ্ট্রপতি আমাদের তখন আমাদের বলে ছিলেন, আমি নিজেই সংবিধানের মানুষ।
যেহেতু সংবিধানে আছে, একবার আইন হয়ে গেলে আর প্রশ্নের উদ্রেক হবে না। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও সার্স কমিটি রেখে ইসি নিয়োগ আইন করায় আমারা আশাহত হয়েছি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই