ঢাকা : বাংলাদেশে করোনা আছে- ভয় পালিয়েছে। নমুনা পরীক্ষা কমলেও করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র এখনো ভয়াবহই বলতে হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমনটা বলেছেন।
এখন আমরা যেভাবে চলছি, এমন ভয়হীন চলাচল আমাদের যে মৃত্যুর মুখোমুখি করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মহামারী হেলাফেলা সত্যিই আত্মঘাতী।
মানুষের স্বাভাবিক চলা ফেরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে মাস্কবিহীন চলাফেরা ভাবনায় ফেলেছে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
ঢিলেঢালা জীবনযাত্রায় করোনাভাইরাস দেশে যে-কোনো সময় আরো বেশি তাণ্ডব চালাতে পারে। বিষয়টি ভাবনার বটে।
হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতে মানুষ আর করোনা নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ভালো চিকিৎসা পায়নি বলে করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন মানুষ আগের মতো হাসপাতালমুখীে হচ্ছে না।
সরকার যথেষ্ট সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করেছেন। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনেকটাই কাটিয়ে উঠছে। ক্ষতিও তুলনামলূক কম হয়েছে। তবে নাগরিক সচেতনতার অভাব এবং দায়িত্বহীন নাগরিকত্ব আমাদের বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে।
সরকার, এমনকি সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও করোনায় স্বাস্থ্যবিধি কেউই মানছেন না। এই না মানার প্রবণতা, উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা আবার আমাদের নতুন করে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখনো সচেতন না হলে বড় বিপদে পড়তে সময় লাগবে না।
বাংলাদেশে হঠাৎ সংক্রমণের হার আবার বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ মনে করে, সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে ইউকে ভেরিয়ান্ট ছড়িয়ে পড়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা দেওয়ার পর অনেকের মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, করোনার ঝুঁকি কমছে, তাই আর স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি না মানলেও চলবে। ফলে একটা ঢিলেঢালাভাব চলে আসে। আগে মাস্ক না পরলে রাস্তাঘাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা জরিমানা করতেন। এখন আর সেই কড়াকড়ি নেই।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন আগের দিনের তুলনায় রোগী বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে শনাক্তের হার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। করোনা ডেডিকেটেড একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েকদিনে রোগী বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এবারকার রোগীদের জটিলতা বেশি।
রোগী বাড়ছে, তাই হাসপাতালের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিঞা বলেন, তাদের শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেই রোগী ভর্তি রয়েছে।
অন্যান্য হাসপাতালে বেড ফাঁকা। রোগী বাড়লে ঢামেক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হবে।
ভাইরাস সম্পর্কে যা মেনে চলা জরুরি : ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু ব্যবহার করা, ব্যবহারের পর টিস্যু পেপারটি ধ্বংস করে হাত ধুয়ে নিয়ে নেওয়া এবং পানি পান করা, যা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে মানুষ থেকে মানুষে। ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান কারণ মানুষের সংস্পর্শে আসা।
তাই সকলের উচিত জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে না যাওয়া। জ্বর, কাশি, হাঁচির লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মাছ, মাংস সম্পূর্ণ সিদ্ধ করে খাওয়া, ধূমপান না করা ইত্যাদি।
‘করোনাভাইরাস নিয়ে নেই কোনো আতঙ্ক নয়, দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি’-এটাই হোক করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় প্রতিপাদ্য বিষয়।
অনেক ভাইরাসের সংক্রমণ শীতকালে বেড়ে যায় : ভাইরাল সংক্রমণের মৌসুমি প্রভাবগুলো মানুষের আচরণ ও ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যসহ একাধিক কারণের ওপর নির্ভরশীল। যেমন কিছু ভাইরাস গরম ও আর্দ্র পরিবেশ পছন্দ করে না।
পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয়েছে, কোভিড-১৯ সরাসরি সূর্যের আলো ছাড়া শীত ও শুষ্ক পরিবেশ পছন্দ করে।
কৃত্রিম অতিবেগুনি রশ্মি পৃষ্ঠতল ও অ্যারোসলে বিশেষত প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সার্স-কোভ-২ কণাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। সংক্রামক ভাইরাস গরম ও আর্দ্র পরিবেশে পৃষ্ঠগুলোতে দ্রুত হ্রাস পায়।
শীতকালে লোকেরা সাধারণত ঘর ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম করে, বায়ু শুষ্ক থাকে এবং বায়ু চলাচলের ভালো ব্যবস্থা থাকে না। এজন্য ঘরের মধ্যে ভাইরাস কণা বেশি সময় বাঁচতে পারে।
বোস্টনের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গণিতবিদ মরিসিও স্যান্তিলানা বলেছেন, শীতের সময় লোকেরা কম বায়ু চলাচলের স্থান বাড়ির ভেতরে বেশি মিথস্ক্রিয়া করবে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।
তবে নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় মহামারী বিশেষজ্ঞ রাচেল বাকের বলছেন, ঋতুর সামান্য প্রভাব থাকলেও সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল চালক হবে বিপুলসংখ্যক লোক, যারা এখনো সংক্রমণের প্রতি সংবেদনশীল। তবে মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্বের মতো ব্যবস্থা প্রাদুর্ভাবের আকার প্রভাবিত করার সবচেয়ে বড় কারণ।
গবেষকরা বলছেন, এটা এখনই বলা সম্ভব নয় যে কোভিড-১৯ একটি মৌসুমি ভাইরাসে পরিণত হবে কি না। তবে ক্রমবর্ধমান প্রমাণগুলো বলছে, মৌসুমি প্রভাব সম্ভবত বড় ধরনের প্রাদুর্ভাবে অবদান রাখবে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ধরনের রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কলিন কার্লসন বলেন, মৌসুমি প্যাটার্নটি আদৌ প্রভাবিত করবে কি না এবং করলে সেটা কেমন হবে তা নির্ভর করবে প্রতিরোধ ক্ষমতা কতদিন স্থায়ী হয়, সংক্রমণ থেকে সেরে উঠতে কত সময় লাগে এবং পুনরায় সংক্রমণের আশঙ্কা কতটা ইত্যাদিসহ এখনো বোঝা যায়নি এমন অনেক কারণের ওপর।
বিস্তার কমানোর ভালো উপায় মাস্ক : সারা বিশ্বে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের চেয়েও সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মাস্ক ব্যবহার করা।
কারণ করোনাভাইরাস মূলত বাতাসে ড্রপলেটস বা মুখ থেকে নিঃসৃত মিহি জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। আর মাস্ক ব্যবহার করলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় বলে নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষকরা ইতালি ও নিউইয়র্কে করোনা রোধে মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করার আগে ও পরের করোনা সংক্রমণের হারের তুলনা করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, দুই জায়গায়ই মানুষ বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারের পর থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে।
গবেষকরা বলছেন, মাস্ক ব্যবহারের কারণেই ইতালিতে গত ৬ এপ্রিল ও ৯ মে ৭৮ হাজারের বেশি করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা গেছে। আর ১৭ এপ্রিল ও ৯ মে নিউইয়র্কে ৬৬ হাজারের বেশি করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা গেছে। ১১ জুন প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে এই গবেষণাবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে করোনার বিস্তার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার করা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এর পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টাইন ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে কোভিড-১৯-এর প্রতিরোধে কাজ করেই যেতে হবে।
গবেষকরা বলেছেন, মানুষের হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সামনে থাকা মানুষের কাছে সরাসরি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার মানুষের হাঁচি-কাশি থেকে বের হওয়া ড্রপলেট বাতাসে ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে যায়। ছোট্ট এই ড্রপলেটকে বলে অ্যারোসল। এই অ্যারোসল মানুষের পায়ে পায়ে বা বাতাসে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। পরে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা প্রতিরোধে ইতালির উত্তরাঞ্চলে ৬ এপ্রিল থেকে মাস্ক পরা শুরু হয়। আর সারা দেশে ৪ মে থেকে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। নিউইয়র্ক সিটিতে ১৭ এপ্রিল থেকে মাস্ক ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গবেষকরা এই তারিখগুলোতে করোনার সংক্রমণের হার বিশ্লেষণ করেছেন।
গবেষকরা বলেছেন, মুখমণ্ডল ঢেকে মাস্ক ব্যবহারে সরাসরি ড্রপলেট বা বাতাসে ভাসা জলকণা থেকে করোনা সংক্রমণ ও অ্যারোসল থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও হাত স্যানিটাইজ করা সরাসরি ড্রপলেট বা বাতাস থেকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিউএইচও) ও ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন করোনাভাইরাসের কন্ট্যাক্ট ট্রান্সমিশন প্রতিরোধের ওপর জোর দিয়েছে। ইতালিতে ৯ মার্চ থেকে লকডাউন কার্যকর ছিল।
ফেস মাস্ক কতটা নিরাপদ : ফেস মাস্ক তৈরি করা হয় মূলত মুখ ও নাকের মাধ্যমে নির্গত আমাদের শ্বাসযন্ত্রের ড্রপলেটকে আটকানোর জন্য।
ইউনিভার্সিটি অব লিডসের বায়ুবাহিত রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ক্যাথ নোয়াকাস বলেন, আপনি যদি আপনার হাত, নাক, মুখ কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশের নমুনা নেন তবে আপনি একই রকম কিছু দেখতে পাবেন। কারণ দীর্ঘস্থায়ী মাস্ক পরার কারণে ঘর্ষণ ও আর্দ্রতার সঙ্গে মিলিত হয়। যার ফলে একীভূত হওয়া এই জীবাণুগুলো ‘মাস্কনে’ নামক প্রাদুর্ভাব শুরু করতে পারে।
কনসালট্যান্ট ডারমাটোলজিস্ট ড. থিভি মারুথাপ্পু বলেন, মাস্ক পরার সঙ্গে সম্পর্কিত মুখের সব র্যাশকে এ টার্ম দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যেখানে ব্রণও অন্তর্ভুক্ত।
ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও ভাইরাসের জন্য মাস্ক যদি ভেক্টর হয়, তবে আমি পরামর্শ দেব আপনি প্রতিদিন মাস্ক ধুয়ে ফেলুন, যদি আপনি তা প্রতিদিন ব্যবহার করে থাকেন।
মূলত প্রতিবার ব্যবহারের পরই আমার উচিত মাস্ক ধুয়ে ফেলা। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর উইলিয়াম রিসটেনপার্ট বলেন, বার বার ধোয়া বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যখন আপনি সংবেদনশীল কারো সংস্পর্শে আসবেন।
সম্প্রতি তিনি আবিষ্কার করেছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দূষিত ধূলিকণায় ভ্রমণ করতে পারে। ম্যাকইনটাইরে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে কাপড়ের মাস্কের একটি ট্রায়াল সম্পন্ন করেছিলেন এবং সেখানে দেখেছিলেন যে সার্জিক্যাল মাস্কের তুলনায় এটা স্টাফদের কেবল সুরক্ষা দিতেই ব্যর্থ না, বরং এটি অসুস্থতার ঝুঁকিও অনেক বাড়িয়ে দেয়। মাস্ক পরার আগে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে মাস্কগুলো আরো বেশি ছিদ্রযুক্ত যে কারণে সেগুলো কম কার্যকর। সূত্র : নেচার জার্নাল, সায়েন্স অ্যালার্ট, দ্য গার্ডিয়ান
সোনালীনিউজ/এমটিআই