ঢাকা : এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। সবশেষ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও সুবিধা করতে পারেনি দলটি। ফলে সংসদে বিরোধী দলে থাকার সুযোগও হারাতে হয়েছে তাদের। এখন তাদের সামনে লক্ষ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারা, শর্তের বেড়াজালে তার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ না থাকা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের লন্ডনে অবস্থান- সব মিলিয়ে অনেকটা নেতৃত্বসংকটে দলটির নেতাকর্মীরা।
এখন দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাংগঠনিকভাবে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতাবলয়ের বাইরে থাকা দল বিএনপি। দলটির এখন প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, নির্বাচনকালে দলনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা। এ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা।
ক্ষমতাসীন দলের সাথে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা না হলে এ দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এজন্য সংগঠনকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে দলটির ঢাকা নগরসহ সারাদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে জোরেশোরে। এ কাজ করতে গিয়ে এরই মধ্যে যারা আন্দোলনে ছিলেন তাদেরকেই কমিটিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে দলটি। এজন্য দলের ‘প্রভাবশালী ও চেনামুখ’ও বাদ পড়ছেন কমিটি থেকে।
দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, এর পাশাপাশি খুব কম সময়ের নোটিশে যেন নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায় সে প্রস্তুতিও রাখছে বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে এক দফার আন্দোলনের জন্য নতুন করে একটি নির্বাচনি জোট গঠন কিংবা একই দাবিতে ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে সমন্বিত কর্মসূচি দেওয়া যায় কি না- তা নিয়ে এরই মধ্যে ক্ষমতাসীনদের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলা শুরু করেছে বিএনপি।
নির্বাচনে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ঢাকাসহ তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সাথে যোগাযোগে বাড়িয়ে দিয়েছেন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
রমজানে এলাকার জনগণের জন্য ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছেন তারা, ঈদের পর করছেন ঈদ পুনর্মিলনী। বিএনপির এসব আয়োজনে দেশের অনেক জায়গায় বাধা দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে।
গত ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যে বৈঠক হয়, তাতে আগামী দ্বাদশ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য পরামর্শ আসে বলে জানিয়েছেন শাসক দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এজন্য তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারা নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এবং সেই নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে, তা দিয়ে একটি জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও পার্লামেন্ট গঠিত হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগে আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করব। তারপর জাতীয় নির্বাচন। সে জন্য সব প্রস্তুতিও আমাদের আছে। বর্তমান অবৈধ সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না।’
দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। সে দাবি আদায়ের পরই বিএনপি নির্বাচনে যাবে।’
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের পর আর কোনো নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিএনপি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি।
এর আগে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে দিলে, সেই থেকে এ ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে দলটি।
তবে এ দাবি সত্ত্বেও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় তারা। এ জন্য ২০ দলীয় জোটের বাইরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নামের অপর একটি জোট করে বিএনপি। এরপরও ওই নির্বাচনে বিজয় লাভ করতে পারেনি তারা।
তবে দ্বাদশ নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার প্রাক্কালে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এক দফার আন্দোলন এগিয়ে নিতে একটি ঐক্যমঞ্চ গঠনের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীনদের বাইরের দলগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে বিএনপি।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলেছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
যেসব দলের সাথে আলোচনা হয়েছে, সেসব দলের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, নতুন করে জোট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। তবে তারা ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে থেকে সমন্বিত কর্মসূচির প্রস্তাব রেখেছেন। এতেও বিএনপির সম্মতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে বেশ কয়েকটি দল যেমন- জেএসডি সভাপতি আ স ম রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠনক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ আরো অনেকেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষে। এ মতের বিপক্ষে নয় বিএনপিও।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল জাতীয় সরকারের বিষয়ে বলেছেন, নির্বাচন হবে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে। নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তারাই ওই জাতীয় সরকারে থাকবে।
সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সমঝোতায় না এলে একটি জোরদার আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রসহ তৃণমূলে সংগঠনকে গুছিয়ে সুসংগঠিত করছে দলটি। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুনভাবে দ্রুত পুনর্গঠন করা হচ্ছে।
জানা গেছে, বিএনপির ৮১টি সাংগঠনিক জেলা ইউনিটের কমিটি হালনাগাদকার্যক্রম চলমান আছে। বেশির ভাগ জেলায় মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুনভাবে কমিটি করা হচ্ছে। একইভাবে যেসব উপজেলা কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ সেগুলোও ভেঙে নতুনভাবে পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
সারা দেশে বিএনপির ৮১টি সাংগঠনিক জেলা শাখার মধ্যে অন্তত ৩০টির বেশি জেলার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। বাকি শাখাগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি করা হচ্ছে। যেসব জেলায় আহ্বায়ক কমিটির পর সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে সেগুলো বাদ থাকছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতরের তথ্য মতে, সারাদেশে ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে নতুন করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে প্রায় ৪৫টিতে। আংশিক কমিটি আছে ১২ জেলায়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে ৩০টিরও বেশি জেলায়। বিভিন্ন মহানগর ও জেলায় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ছাত্রদলের সাবেক নেতা- নেত্রীদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
যার প্রমাণ মিলেছে কৃষক দল, ঢাকা মহানগর মহিলা দলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে। দল গঠন-পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী মহিলা দল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের ১০ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপি।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারপর খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে।
এছাড়া গত ২৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগর বিএনপির ৭১ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি করা হয়েছে। তাছাড়া বরিশাল মহানগর বিএনপির কমিটিও নতুনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। এ রকম একটি নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ঈদকে উপলক্ষ করে নিজ নিজ এলাকায় চষে বেড়িয়েছেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা নির্বাচনী এলাকায় ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় ও উপহার সামগ্রী বিতরণসহ নানাভাবে যোগাযোগ রেখেছেন। তারা লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঈদ শুভেচ্ছা পৌঁছে দিয়েছেন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই