ঢাকা : দেশজুড়ে হঠাৎ করে বাড়ছে বিদ্যুত সংকট। ফলে রাজধানীসহ বিভিন্নস্থানে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিঘ্ন ঘটছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। শুধুমাত্র গ্যাস সরবরাহ বাড়লেই লোডশেডিং থেকে মুক্তি মিলবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে শিগগির জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কমার সম্ভাবনা নেই; বরং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে আগামীতে দাম আরো বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলছে। গ্যাসের সরবরাহ না বাড়া পর্যন্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চারদিন ধরে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং অনেক বেড়েছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। খোদ রাজধানীতেই দিনে ৫-৬ বার লোডশেডিং হচ্ছে। দেশের অনেক এলাকায় দিনের ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবি বলছে, পেট্রোবাংলা তাদের গ্যাস কম দিচ্ছে, এ জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে টান পড়েছে। আবার জ্বালানির দাম বেশি বলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না। এতে দেশজুড়ে ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
পেট্রোবাংলা বলছে, গত দুই সপ্তাহে গ্যাস সরবরাহ ৩০ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে এলএনজি কিনছে না বাংলাদেশ। জুন মাসে স্পট মার্কেট থেকে তিনটি এলএনজি কার্গো কেনা হয়েছিল। জুলাই মাসে কোনো কার্গো কেনার উদ্যোগ নেই।
বিশ্বে চলমান জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী বাজারের কারণে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে সরকার সাশ্রয়ী নীতি বাস্তবায়নে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, গত জুনের শেষ সপ্তাহে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে প্রতি ইউনিটে (এমএমবিটিইউ) খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ ডলার। সেটি এখন হয়ে গেছে প্রায় ৪০ ডলার। এ কারণেই সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছে।
এ অবস্থায় জাতীয় গ্রিডে যে পরিমাণ গ্যাস ঘাটতি হচ্ছে, তা দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে জোগান দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য বেশ কয়েকটি কূপে ওয়ার্কওভার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রাজধানীতে ডিপিডিসি গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে বলেছে, গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিদুৎ উদপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদার তুলনায় ডিপিডিসিকে কম বিদ্যুৎ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ডিপিডিসির কিছু কিছু এলাকায় অনিচ্ছকৃত লোডশেডিং করা হচ্ছে। গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য ডিপিডিসি দুঃখও প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিংও করছে তারা।
মগবাজারের বাসিন্দা মাহবুব আরা জানান, দীর্ঘদিন লোডশেডিং ছিল না। হুট করে এমন ঘটনায় আমরা বিভ্রান্ত। গত শুক্রবার থেকেই দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার আধঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। লালমাটিয়ার বাসিন্দা করিম হোসেন জানান, বাসায় দুজন রোগী। এসি কিনেছিলাম। এখন তো ফ্যানই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। নতুন করে ভোগান্তিতে পড়লাম। আর মিরপুরের এক বাসিন্দা জানান, সারা দিন বার বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এমনিতে গরম। শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট বাড়বে।
এদিকে, দাম না কমলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
অন্যদিকে, সংকট কাটাতে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
সূত্র জানায়, এলএনজি সরবরাহ কমায় গ্যাস ঘাটতি বেড়েছে ৩০-৩৫ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, তা কোনোভাবেই আগামী কয়েক মাসের চেষ্টায় ১০-১৫ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বাড়বে না। জ্বালানি তেলের দামও বেশি বলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে পারছে না পিডিবি। ফলে চলমান গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট খুব শিগগির কাটবে না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেই শুধু দেশের বিদ্যুৎ-গ্যাস পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং করোনা পরবর্তী চাহিদা বাড়ায় আগামী কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়তির দিকে থাকবে।
বাজার বিশ্লেষণকারী সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস বলছে, জাপান ও ইউরোপের চাহিদা বাড়ায় এলএনজির দামও ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আপাতত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে।
গ্যাসস্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, এতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোকেও এখন বিদ্যুৎ সরবরাহে রেশনিং করতে হচ্ছে। জ্বালানির উচ্চমূল্য অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে।
পিডিবির তথ্যমতে, গত রোববার দেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। গত সোমবার লোডশেডিং ২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। আর গতকাল মঙ্গলবারও লোডশেডিং ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী ডিপিডিসি ৩০০ মেগাওয়াট ও ডেসকো ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) চাহিদার চেয়ে ৮০০-৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে।
ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানি জানিয়েছে, সব মিলিয়ে তাদের ৩০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে এলাকাভেদে ৩০ মিনিট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, গতকাল সকালে ১৪০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পেয়েছি। সন্ধ্যায় তা কমে ১২০০/১২৫০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে আমাদের ১২০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমির আলী বলেন, আমাদের ঘাটতির পরিমাণ ১৫০ থেকে ১৭৫ মেগাওয়াটের মতো। চাহিদা থাকে ১০০০ মেগাওয়াট। সকালে পেয়েছি ৮৫০ মেগাওয়াট। এখন চাহিদা কিছুটা বেশি হওয়ায় লোডশেডিং বাড়বে। বিভিন্ন এলাকায় আধঘণ্টা লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসসংকটের কারণে গত কয়েক দিনে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এদিকে জ্বালানি তেলের দামও চড়া। দিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান করছে বিপিসি। তাই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে লোড শেডিং দিতে হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, এখন উন্নত দেশগুলোও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎসেবা দেওয়ার জন্য রেশনিং করছে। জাপানের মতো দেশ এখন পরিকল্পিতভাবে দিনে দুই ঘণ্টা লোড শেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের অবস্থাও খারাপ। কারণ আমাদের যে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম।
তিনি বলেন, এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তাহলে উৎপাদন খরচ তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেটি বাস্তবায়নসহ আরো বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এদিকে, গ্যাসসংকটের প্রভাব পড়ছে আবাসিক ও শিল্প-কারখানায়। তিতাস সূত্র বলছে, রাজধানীর মিরপুর, বাড্ডা, কেরানীগঞ্জ, কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। কোনো রকমে রান্নার চুলা জ্বলছে এসব এলাকায়। সাভার, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসসংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলেও অভিযোগ আসছে।
জানা গেছে, আরইবির বাইরে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা নেসকো ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। দক্ষিণের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ওজোপাডিকো ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতিতে রয়েছে। ফলে এসব এলাকার গ্রাহকরা দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। গতকাল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট, পিডিবি সরবরাহ করেছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট।
সোনালীনিউজ/এমটিআই