ঢাকা : দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্রের স্বীকৃতি পেল ভোলার ইলিশা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানীকৃত এলএনজির মূল্য বিবেচনায় এখানে মজুদকৃত গ্যাসের মোট মূল্য নিরূপণ করা হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর জমি অধিগ্রহণ থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়সহ এখান থেকে অনুসন্ধান ও কূপ খননসহ এখন পর্যন্ত জ্বালানি বিভাগের মোট খরচ হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা।
গ্যাসের চাহিদা পূরণে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় উত্তোলন ও অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত বলে বিভিন্ন সময়ে মত দিয়েছে জ্বালানি খাতের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান। দেশে গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে গিয়ে ২০১৭ সালে ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বল এক প্রক্ষেপণে বলেছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশে চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিতে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ প্রয়োজন হবে। আমদানিনির্ভর না থেকে এ অর্থ যদি স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উন্নয়নে কাজে লাগানো হয়, তাহলে এখান থেকে সুফল পাওয়া যাবে আরো অনেক বেশি।
বাস্তবেও স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সফলতার দেখা পেয়েছে জ্বালানি বিভাগ। ২০২২ সালজুড়ে নয়টি কূপে অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ওয়ার্কওভার চালিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। এতে বাপেক্সের ব্যয় হয়েছে ৮১২ কোটি টাকা। আর এ বিনিয়োগের মাধ্যমে এলএনজি আমদানিতে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকার ব্যয় সাশ্রয় করেছে বাপেক্স। ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রেও একইভাবে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার গ্যাসের সংস্থান হয়েছে মাত্র ১৯০ কোটি টাকা ব্যয় করে।
বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত একটি গ্যাসকূপ খনন থেকে শুরু করে গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত তিন-পাঁচ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। যদিও ইলিশা-১ কূপটি খনন করে গ্যাস পেতে সময় লেগেছে ১ মাস ১৬ দিন। তবে ইলিশা থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে এখনো দেড়-দুই বছরের মতো সময় প্রয়োজন বলে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাপেক্সের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইলিশা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে দেড়-দুই বছরের মতো সময়ের প্রয়োজন। ওখানে প্রসেস প্লান্ট, পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। সেখানে থাকা অন্য গ্যাস পাইপলাইনের সঙ্গেও যুক্ত করতে হবে।’
গ্যাসক্ষেত্রটিতে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ নিরূপণ হয়েছে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস বিক্রির মূল্য বিবেচনায় মজুদকৃত গ্যাসের আর্থিক মূল্য ৬ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে আমদানীকৃত এলএনজির দাম হিসাব করলে ইলিশায় পাওয়া গ্যাসের মূল্য প্রায় ২৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
বাপেক্সের তত্ত্বাবধানে ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রের কূপ খনন (ইলিশা-১) করেছে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম। বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদারের বিল, কূপের প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়, পরিচালন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৯ মার্চ ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মালেরহাট এলাকায় ইলিশা-১-এর খননকাজ শুরু হয়। এরপর গত ২৪ এপ্রিল ৩ হাজার ৪৭৫ মিটার গভীরে তিনটি স্তরে ‘ড্রিল স্টেম টেস্টের’ (ডিএসটি) মাধ্যমে সফলভাবে খননকাজ সম্পন্ন হয়। ভূতাত্ত্বিক তথ্য ও ডিএসটি টেস্ট অনুযায়ী, কূপটিতে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ ২০০ বিসিএফ। দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে উত্তোলন করলে এখান থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে ২৫-২৬ বছর।
জ্বালানি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ভোলার শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ ও ইলিশা মিলে ২ দশমিক ২৩ টিসিএফ (লাখ কোটি কিউবিক ফুট) গ্যাসের মজুদ রয়েছে। আর ভোলা থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দৈনিক উত্তোলন করা সম্ভব বলে জানায় সরকারের এ বিভাগ (জ্বালানি বিভাগ)।
ভোলার ইলিশাকে গতকালই দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। রাজধানীতে গতকাল নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ভোলায় আবিষ্কৃত তিনটি গ্যাসকূপ থেকে ১৫০-২০০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। এ গ্যাস আমাদের একটা বড় সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করল। গ্যাস সংকট পরিস্থিতির মধ্যে এটা সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের জন্য সুখবর। ভোলায় প্রায় তিন টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে।’
জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থবির ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। স্থানীয় বিনিয়োগে অবহেলা থাকলেও গ্যাস খাতে এলএনজি আমদানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। এ কারণে এতদিন গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। দেরিতে হলেও অনুসন্ধান কার্যক্রমের এ তৎপরতা যাতে ধীর না হয়, সে বিষয়েও জ্বালানি বিভাগের জোরালো তদারকি থাকা দরকার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘কূপ খনন করলেই যে গ্যাস পাওয়া যাবে, তা আমরা দীর্ঘদিন বলে আসছি। ইলিশায় গ্যাস পাওয়া তার বড় প্রমাণ। কেউ কেউ মনে করেন, দেশে গ্যাস নেই। আসলে তা সঠিক নয়। আমরা আরো কূপ খনন ও জরিপ চালালে গ্যাস পাব। আর গ্যাস পেলে যে পরিমাণ অর্থের এলএনজি আমদানি করছি, তার খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারব। একটি আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর ভরসা করে আমরা বসে থাকতে পারি না।’
জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস স্থানীয় উৎস থেকে যুক্ত হবে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করছে বাপেক্স।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘জ্বালানি বিভাগের আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাপেক্স সর্বাত্মক কাজ করে যাবে। আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাপেক্স কোথায়, কোন এলাকায় কূপ খনন করবে সেই পরিকল্পনাও সাজানো রয়েছে।’ সূত্র : বণিক বার্তা
সোনালীনিউজ/এমটিআই