নতুন ভিসানীতি

বিএনপির পরিকল্পনায় কাট, আ.লীগের হিসাব-নিকাশ এলোমেলো 

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২৩, ০৯:৪৫ পিএম

ঢাকা: সময় যতই যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলোচনা এবং উত্তাপ ততই বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে ঈদুল আজহার পর পুরোদমে গরম হয়ে উঠবে রাজনীতির ময়দান।তবে মার্কিন নতুন ভিসানীতির ফলে রাজনৈতিক প্ল্যান-পরিকল্পনা কিছুটা বদলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 

যদিও নতুন ভিসানীতি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে উৎসাহিত করতে এই ভিসানীতি। 

এদিকে জানা গেছে, বিএনপির সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর। সবকিছু ঠিক থাকলে জুনেই সমমনাদের নিয়ে একমঞ্চ থেকে সরকার পতনের একদফার ঘোষণা দেবে বিএনপি। ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে আন্দোলন রূপরেখার খসড়া। সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগিরই তা চূড়ান্ত করা হবে। তবে চূড়ান্ত আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া হয়েছে কঠোর পরিকল্পনা। থাকছে না হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি। 

বিএনপি চাইছে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে বড় জমায়েতের মধ্য দিয়ে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে। 

আরও পড়ুন<<>>গাজীপুরে হার কেন?তৃণমূলে অনৈক্য, নাকি মার্কিন ভিসানীতি

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল দলটির জন্য এক কথায় ‘ড্রেস রিহার্সেল’। বিএনপিবিহীন ভোটে অনেকটা হেসেখেলেই জয়ের সুফল ঘরে তোলার কথা তাদের। কিন্তু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন শাসক দলের হিসাব-নিকাশ এলোমেলো করে দিয়েছে।

এঅবস্থায় দলের ভেতরের বিভেদ মেটানোর পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে নিবিড় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ। ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ যারা তুলছেন-তাদের বিষয়ে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সঙ্গী শরিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ বিরোধী বলয়কে মোকাবিলায় এর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। 

আরও পড়ুন<<>>সেমিফাইনালের প্রথম দিনে উজ্জীবিত বিএনপি

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের একটা বড় কারণ তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধেও জর্জরিত দলটি। এর সঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ। যার কারণে নির্বাচনে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম হচ্ছে। পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামাল দিতে না পারলে ভবিষ্যতে এই সংকট আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 

তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগকে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি যত্নবান এবং সতর্ক হতে হবে। বিতর্কিত কাউকেই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, আগামীতে বিতর্কিত কাউকে দল থেকে মনোনয়ন দেবেন না। এর অর্থ দাঁড়ায় তার দলে বিতর্কিত লোকজন আছে। এই বিতর্কিতদের বিষয়ে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বিতর্কিত ব্যক্তিরাই সমস্যা সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে তাদের দলের আন্তঃবিরোধ মেটানো ও স্তিমিত ১৪ দলীয় জোটকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় করতে হবে।

আরও পড়ুন<<>>তৃণমূলে শক্তি বাড়াতে যা করছে আওয়ামী লীগ

এদিকে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে একমঞ্চ থেকে সরকার পতনের একদফার ঘোষণার পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের যৌথ ঘোষণাপত্র তুলে ধরার কথা রয়েছে। বিএনপি ও সমমনাদের ঘোষিত দফাগুলো সমন্বয় করা হচ্ছে। রাষ্ট্র মেরামতে বিএনপির ২৭ দফাকে ৩১ দফায় উন্নীত করে একটি খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে, যা স্থায়ী কমিটি চূড়ান্ত করবে।

৩১ দফার খসড়ায় যা আছে: 
শুরুতেই বলা হয়েছে- দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ‘জাতীয় সরকার’ রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এতে সংবিধান সংস্কার কমিশন নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করাসহ আগে ঘোষিত ২৭ দফা ঠিক রয়েছে। শুধু এর মধ্যে ১৬ নম্বর দফায় যোগ করা হয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১৭ নম্বর দফায় যোগ করেছে নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা হবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ সব বন্ধ শিল্প পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং দেশে বিমানবন্দরসহ সব ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রাপ্তি ও ভোটাধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া ২২ নম্বর দফায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে, ২৬ নম্বর দফায় সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু, ২৭ নম্বর দফায় পর্যায়ক্রমে সব ইউনিয়নে কৃষিপণ্যের জন্য সরকারি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন এবং কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন এবং গবেষণার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট রপ্তানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেওয়া হবে-এসব যোগ করা হয়েছে। এর বাইরে নতুন চারটি দফা সংযোজন করা হয়েছে। ২৮ নম্বর দফায় রয়েছে-দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সারা দেশে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থ গড়ে তোলা হবে। দেশের সমুদ্রবন্দর ও নৌবন্দরসমূহের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে। ২৯ নম্বরে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও ক্ষতি মোকাবিলায় টেকসই ও কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাধুনিক ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। নদী ও জলাশয় দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বন্যা ও খরা প্রতিরোধে খাল-নদী খনন-পুনর্খনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত জরিপ ও মজুতের ভিত্তিতে তা আহরণ এবং অর্থনৈতিক ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩০ নম্বরে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সর্বক্ষেত্রে এর প্রয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তি কমিশনের কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক সুযোগ সমৃদ্ধ করা হবে এবং ৩১ নম্বরে এক জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে শহরে ও গ্রামে কৃষিজমি নষ্ট না করে এবং নগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ হ্রাস করে পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়ণের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিত করা হবে। সবশেষে দলটি বলেছে, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই রূপরেখা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ‘১৯ দফা’, খালেদা জিয়া ঘোষিত বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’ এবং তারেক রহমানের ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচির আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে এই খসড়া সমমনা রাজনৈতিক জোট ও দলের হাতে দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় কারও কোনো আপত্তি বা পরামর্শ থাকলে তাও আমলে নেওয়া হবে বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছে। 

আরও পড়ুন<<>>নির্বাচন পর্যন্ত পালটা কর্মসূচি চলবে

দলটির নেতারা মনে করেন, সম্প্রতি সব সাংগঠনিক জেলা ও মহানগরে জনসমাবেশ ও পদযাত্রার কর্মসূচিতে আন্দোলনের গতি বেড়েছে। মার্কিন নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর নেতাকর্মীরা আন্দোলনের মাঠে নতুনভাবে উদ্দীপনা পেয়েছেন। মাঠের এই আবহ একদফার আন্দোলন সফল করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আর কোনো দশ দফা নয়, এখন একটাই দাবি-শেখ হাসিনার পদত্যাগ। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন। তবেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে।’ 

আরও পড়ুন<<>>সংবিধানের বাইরে যাবে না আ.লীগ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক শীর্ষ নেতা জানান, স্থায়ী কমিটির গত চারটি বৈঠকে একদফা আন্দোলন প্রশ্নে করণীয় কী কী হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরে বলেন, বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তড়িঘড়ি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করতে পারে। যেভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে- একদফা আন্দোলনের দিনক্ষণ এগিয়ে না আনলে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন করার মতো নেতাকর্মী মাঠে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া সামনে আগস্ট মাস এবং বর্ষাকাল রয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে জুনেই একদফার আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা হচ্ছে।

আরও পড়ুন<<>>তৃণমূলকে ভোটে চাঙ্গা রাখাই আ.লীগে মূল চ্যালেঞ্জ

তিনি আর বলেন, সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন জেলা ও মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, দলের সাবেক এমপি-মন্ত্রী এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এছাড়া দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক, সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা সমন্বয় বৈঠক করেছেন। সবাইকে দ্রুত একদফার আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/আইএ