আগুনে রাজনীতি আগুনে মৃত্যু

দেড় মাসে ৭ নাশকতার ঘটনা

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২০, ২০২৩, ১১:৫৮ এএম

ঢাকা : মায়ের সঙ্গে নেত্রকোনায় নানার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল শিশু ইয়াসিন ও ফাহিম। হরতাল-অবরোধ ঘিরে সহিংসতার মধ্যে সন্তানদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তুলনামূলক নিরাপদ বাহন হিসেবে ট্রেন যাত্রা বেছে নিয়েছিলেন মা নাদিরা আক্তার পপি (৩৫)। কিন্তু সেই ট্রেন যাত্রাই কাল হলো।

মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরে বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালের শুরুতে রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে আঙ্গার হয়েছেন পপি ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন রহমান পিয়াস। ট্রেনে আগুনের এ ঘটনায় পপি, ইয়াসিনসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে চলন্ত ট্রেনটির তিনটি বগি পুড়ে গেছে। নিহত চারজনই পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। নিহত অন্য দুজনের মধ্যে একজনের নাম আব্দুর রশিদ ঢালী (৬০)। আরেকজনের পরিচয় জানা যায়নি।  রশিদ ঢালীকে বিএনপি তাদের নেতা বলে দাবি করেছে।

এ ছাড়া গতকালের হরতাল কর্মসূচি শুরুর আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রেললাইনের নাট খুলে নেওয়া এবং বাস-ট্রাকে আগুন, ভাঙচুরসহ নাশকতার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসছিল। ভোর ৫টার দিকে বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে খিলক্ষেতে এলে যাত্রীরা বগিগুলোয় আগুন দেখতে পান। তারা চিৎকার শুরু করেন। এরপর চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন।

[213577]

আগুনে ট্রেনের বগিতে আটকে পড়ে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে পুড়ে অঙ্গার হন পপি। আঙ্গার হয়ে যাওয়া মা ও শিশুর মরদেহ আলিঙ্গনরত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। বীভৎস এই দৃশ্য দেখে চিকিৎসক, নার্সসহ দশনার্থীরা হতবিহবল হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসকদের চেষ্টায় মাকে আঁকড়ে ধরা শিশু ইয়াসিনকে আলাদা করা হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন পপির স্বজনরা। এ সময় কান্না ও আর্তনাদে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

ট্রেনের যাত্রীরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ওঠা তিন ব্যক্তি বগিতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের পরনে ছিল ট্রেনের গার্ডদের মতো দেখতে পোশাক।

এর আগে ১৩ ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধের মধ্যে গাজীপুরের ভাওয়ালে রেললাইন কেটে ফেলায় এই মোহনগঞ্জ একপ্রেস সাতটি বগিসহ উল্টে পড়েছিল। সেই ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয় এবং এক দিন ধরে ওই লাইনে রেলযোগাযোগ বন্ধ ছিল।

ট্রেনে আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) হাবিবুর রহমান বলেছেন, যারা অবরোধ-হরতাল ডেকেছে, তারাই রেলে আগুন দিয়েছে। আর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, মহল বিশেষের প্রশ্রয় ছাড়া এ ধরনের কাজ সম্ভব নয়।

গত দেড় মাসে রেলপথে অন্তত সাতটি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। হরতাল-অবরোধে যাত্রীদের জন্য এত দিন নিরাপদ যান হিসেবে পরিচিত ছিল ট্রেন। সেই ট্রেনেও সাম্প্রতিক সময়ে নাশকতার থাবা পড়েছে। এতে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে ট্রেন ভ্রমণও।

ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট আলামত সংগ্রহ করেছে। প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়েছে, পেট্রোল ব্যবহার না করলে এত দ্রুত আগুন ছড়ানো সম্ভব নয়। এ ঘটনায় নাশকতার আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)

তেজগাঁও রেলস্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার মো. পর্বত আলী বলেন, ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৪টা ৫০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হয়। তেজগাঁও স্টেশনের কাছে এসে পৌঁছায় ৪টা ৫৪ মিনিটে। যেসব ট্রেন তেজগাঁও স্টেশনে থামে না, সেগুলোর জন্য আমরা সবুজ বাতি জ্বালিয়ে পার হওয়ার সংকেত দিই। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের জন্যও সবুজ বাতি ধরা হয়েছিল।

[213585]

কিন্তু দেখি, ট্রেনের ইঞ্জিনের পেছনের ৫-৭টা বগি থেকে ধোঁয়া উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে সবুজ বাতি পরিবর্তন করে লাল বাতি জ্বালিয়ে বিপদ সংকেত দিই। পাশাপাশি স্টেশন রুমে এসে কম্পিউটারের মাধ্যমেও সব সিগন্যাল বিপজ্জনক করে দিই। এতে ট্রেনটি স্টেশনের শেষ প্রান্তে থেমে যায়।’

পর্বত আলী জানান, ট্রেন থামার পর তাৎক্ষণিক ৯৯৯-এ কল দিয়ে ফায়ার সার্ভিসে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়। পরে ৫টা ৮ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। ৬টা ১৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এরপর ৬টা ২৫ মিনিটে এই রেলপথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়। আগুনে ট্রেনের ছ, জ, ঝ নম্বরের বগি তিনটি পুড়ে যায়। আগুন নেভানোর পর ভেতর থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুড়ে আঙ্গার মরদেহগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। আর আহত একজনকে একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

কয়েকজন যাত্রী জানান, কয়েক মিনিটের মধ্যেই কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রবেশের কথা ছিল ট্রেনটির। বিমানবন্দর স্টেশন ছেড়ে আসার পর অনেকে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আবার অনেকে ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। জেগে থাকা যাত্রীরা হঠাৎ আগুন দেখতে পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলে অনেকে হুড়োহুড়ি করে নামার চেষ্টা করেন। আবার ভোরের ঘুম ঘুম পরিবেশে অনেকে শুরুতে বুঝতেই পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে ট্রেন থেকে নামতে গিয়েও কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মাথায় আঘাত পেয়ে নুরুল হক ওরফে আব্দুল কাদের (৫৩) হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তার বাড়ি। তিনি ঢাকায় হা-মীম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিবহন শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা।

ট্রেনটির আহত যাত্রী নুরুল হক বলেন, ‘আমি ধোঁয়ায় দাঁড়াতে পারছিলাম না। নাখালপাড়া ক্রস করার সময় না পাইরা লাফ দিছি। ওইখানে এক-দেড় ঘণ্টা শুয়েছিলাম। আগুন লাগার আগ মুহূর্তে টের পাইনি। যারা লাগাইছে, প্রথমে এস্টিংগুইশার ছিল, ওইটা সরাইছে এবং ওরা দুইবার আপডাউন মানে যাওয়া-আসা করছে। একজন আরেকজনকে বলছিল এটা কী করবা। ওইটা কী ওই মাথায় নিয়া যাব। ওরা ট্রেনের যে গার্ড সে পোশাক পরা ছিল। ওই সময় তারা হয়তো একজন আরেকজনকে ইশারা দিয়েছে। আমরা তো বুঝতেছিলাম না। হঠাৎ আগুন দেখলাম। প্রথমে দেখলাম অল্প একটু। সবাই বলছিল এই এটা নিভাও নিভাও। কিন্তু ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে পুরা আগুন ধরে গেল। ধোয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। অনেকের অবস্থা ছিল একই রকম। তারা লাফ দিয়ে নেমে গেছে।’

নাশকতা মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, তারা এ ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক নাশকতা’ হিসেবেই সন্দেহ করছেন।

রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. দিদার আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতা বড় কথা নয়, এই নৃশংস ঘটনা যারা ঘটায় তারা মনুষ্যত্বহীন। এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। অতীতে এ রকম যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মতোই এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে ক্রিমিনালদের ধরা হবে।’

[213578]

আগুনের এ ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যারা হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও করছে, যারা নাশকতা করছে তাদের বিদেশি নেতাদের নির্দেশে দেশীয় এজেন্ট-অনুসারীদের দিয়ে এসব কাজ করানো হচ্ছে; যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একটি রাজনৈতিক দল যারা বাসে-ট্রেনে আগুন দিয়ে নাশকতা করছে, এটি তার একটি অংশ। গতকাল দুপুরে হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় নিহতদের লাশ ও আহতদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

আবদুর রশিদ ঢালীকে বিএনপির নেতা দাবি : আগুনে নিহত আব্দুর রশিদ ঢালী নেত্রকোনা জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং নেত্রকোনা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা যুবদলের নেতা ছিলেন জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী শোক জানিয়েছেন।

কুড়িগ্রামে রেললাইনের নাট খুলে নিল দুর্বৃত্তরা : কুড়িগ্রামের রাজারহাটে কুড়িগ্রাম-রংপুর রেললাইনের ঠাঁটমারী বদ্ধভূমি এলাকার রেল সেতুর লাইনের কিছুসংখ্যক হুক বোল্ট (নাট) চুরি করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকেলে কুড়িগ্রাম রেলস্টেশনমাস্টার মো. শামসুজ্জোহা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। দুপুরে রেল ওয়েম্যান কুড়িগ্রাম রেলস্টেশনমাস্টারকে খবর দিলে তারা উপস্থিত হয়ে রেললাইনের কাজ শুরু করেন।

বাসে আগুন : রাজধানীর গুলিস্তানে জিপিওর সামনে গতকাল একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বেলা ১টার দিকে মালঞ্চ পরিবহনের বাসটিতে আগুন দেওয়া হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার রাত ২টার দিকে উপজেলার জোয়ারা বাদামতল বদল ফকির হাটসংলগ্ন আজিজের স্টিলের দোকানের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

হরতালে গতকাল দুপুরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে একটি যাত্রীবাহী বাস, দুটি পণ্যবাহী ট্রাক ও দুটি ড্রাম ট্রাক ভাঙচুর করেছে পিকেটাররা। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পলাশবাড়ী উপজেলার জুনদহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

হরতালের সমর্থনে রাজধানীতে রিজভীর নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল : রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে গতকাল সকাল ৭টায় রাজধানীর শান্তিনগর থেকে রাজারবাগ অভিমুখে মিছিল করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

এ সময় রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন মিছিলে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা। পরে বিকেলে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় পুলিশ আরও ২২৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার এবং ৮টি মামলায় ৭৯৫ জনের অধিক নেতাকর্মীকে আসামি করেছে।’ হরতালের সমর্থনে রাজধানীর বিজয়নগরে মিছিল করেছেন যুবদলের পদবঞ্চিতরা।

ধরপাকড় চলছেই : সারা দেশে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে গতকাল নাশকতার মামলায় বিএনপির দুই নেতাসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। নীলফামারীতে গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শহরের গাছবাড়ি এলাকা থেকে জামায়াতের সাত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ময়মনসিংহে হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল থেকে যুবদলের ৫ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নরসিংদীর মাধবদীতে হরতালে গাড়ি ভাঙচুরের সময় নারায়নগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি লুৎফর রহমান আব্দুকে (৪৯) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এমটিআই