নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘গলার কাঁটা’ যারা

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২৩, ১১:৩৭ এএম

ঢাকা : প্রতীক বরাদ্দের পর সারাদেশে শুরু হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা। জাতীয় পার্টি ও শরীকদের জন্য ৩২টি আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মূল লড়াইটা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। দেশব্যাপী স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জে রয়েছেন নৌকার মাঝিরা।

শক্তির জানান দিয়ে মাঠ দখলের চেষ্টায় প্রার্থীরা। জমজমাট প্রচারণায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এতে বেড়েছে সংঘাত সংঘর্ষের শঙ্কাও।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্তত দেড়শ আসনে নৌকা প্রতীকের গলার কাঁটা ঈগল, ট্রাক। সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান তাদের।  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে সাতশর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী। যেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত আড়াইশর বেশি। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বিপরীতে যারা স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন, তাদের কেউ সাবেক সংসদ সদস্য, কেউ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন। আবার অনেকেই দলের স্থানীয় পর্যায়ে পদধারী নেতা। অন্তত ১৫ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীকেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করে জিততে হবে।

স্বতন্ত্রদের তোপের মুখে পড়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি আওয়ামী লীগের অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী। মাঠের লড়াইয়ে নৌকার প্রার্থীকে একচুলও ছাড় দিতে চান না ঈগল, ট্রাকের প্রার্থীরা।

[213658]

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভোটের সমীকরণ বেশ জটিল করে তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, ডজন খানে মন্ত্রী বেশ ঝুঁকিতে আছেন। সংসদ সদস্যের সংখ্যা আরও বেশি। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই নির্বাচনে  বড় ভূমিকা থাকবে।  

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনালের (অব.) মুহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে বলে আমরা মনে করি। এ জন্য আমরা আশা করি, বিষয়টি নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নেবে।  

নির্বাচনী প্রচারণায় অন্য দলের প্রার্থীরা এখনো তেমন সরব না হলেও মাঠে সক্রিয় স্বতন্ত্ররা। বাকিরা মাঠে নামলে নির্বাচনী পরিবেশ আরও জমজমাট হবে বলেই মনে করেন নির্বাচন পর্যবেক্ষরা।

ঢাকার অর্ধেক আসনে ‘চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন’ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা : বিএনপিহীন নির্বাচনে ঢাকার কয়েকটি আসনে ভোটের হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ আনছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ২০ আসনের ১০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হয়ে উঠতে পারেন কোনো কোনো আসনে।

[213659]

ঢাকা জেলা ও মহানগরের ২০ আসনে ৭ জানুয়ারির ভোটের জন্য প্রার্থী রয়েছেন ১৫৬ জন, যাদের ২১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্যরাও রয়েছেন।

১৮টি রাজনৈতিক দল ঢাকায় ভোটের মাঠে থাকলেও দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত আসছে কেবল ঢাকা-৪ আসনে। এর বাইরে যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের নৌকার প্রার্থীদের মূল লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে।

রাজধানীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনগুলোর একটি ঢাকা-৪ এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সানজিদা খানম। তাকে লড়তে হবে গত দুইবারের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সঙ্গে।

শ্যামপুর-কদমতলীর এই আসনে নৌকা-লাঙ্গলের লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জ বাড়াতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব আওলাদ হোসেন। স্বতন্ত্র এই প্রার্থী দশম জাতীয় নির্বাচনে তিন হাজারের কম ভোটের ব্যবধানে বাবলার কাছে হেরে যান, অবশ্য ওই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

ঢাকা-১৯ আসনে গত দুইবারের সংসদ সদস্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। নির্বাচনে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছেন নৌকার টিকিট না পাওয়া তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং (মুরাদ)।

মুরাদ জং ২০০৮ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। সাভারের এই নির্বাচনী এলাকায় আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম।

ঢাকা-৫ আসনে সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনুর পরিবর্তে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ মুন্নাকে।

ডেমরা-যাত্রাবাড়ি এলাকার জনপ্রতিনিধি হতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। ত্রিমুখী লড়াইয়ে কে জয়ী হবেন তা নিয়ে হিসেব-নিকেশ চলছে ভোটারদের মধ্যে।

[213599]

আসনটিতে নৌকার সঙ্গে লড়ছেন ঢাকা দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন এবং ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা সজল। সজলের বাবা হাবিবুর রহমান মোল্লা এই আসনের চারবারের সংসদ সদস্য ছিলেন।

ঢাকা-১৪ আসনে সবচেয়ে বেশি ৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে সাবিনা আক্তার তুহিন দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল।

সাবিনা আক্তার তুহিনের দাবি, নৌকা প্রতীক না পেলেও প্রচারে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সবার সমর্থনই পাচ্ছেন তিনি।

আমি রাজপথের লোক, এখানে দীর্ঘদিন আছি। এটি আমার নিজস্ব এলাকা। সাধারণ মানুষ আমার জন্য নেমে পড়েছে।

গত ১২ বছরের কার্যক্রম বিবেচনায় নিয়ে ভোটাররা তাকে নির্বাচিত করবেন, সে আশা জানিয়ে তুহিন বলেন, “আমি কাজ করছি। আমার বিশ্বাস, জনগণ আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেবে।

“হুট করে এসে ৫-৭ মাসে ক্যান্ডিডেট যে কেউ হলেই…। যদি কোনো রকম ডিস্টার্ব না করে, ভোটাররা যদি নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারে- তাহলে আমি ভোট পাব। এখনও পর্যন্ত আমরা নির্বিঘ্নে ভোট হওয়ার আশা করছি।”

জাতীয় পার্টির শেরীফা কাদেরের জন্য ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিলেও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আছেন নির্বাচনে। ঢাকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী এই আসনে লড়ছেন।

শেরীফা দল-মতের ঊর্ধ্বে সবার ভোট প্রত্যাশা করলেও নৌকার ভোটারদের কতটা টানতে পারবেন তা-ই নির্ধারণ করে দিবে জয়-পরাজয়ের হিসাব।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক খসরু চৌধুরী আশা করছেন, দলের হিসাব যাই হোক, জনগণের সমর্থন নিজের দিকে টেনে নিতে পারবেন তিনি।

বিজিএমইএর এই পরিচালক বলেন, প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে আশা করছি। আমি কাউকে ছোট করে দেখি না। আমার সর্বোচ্চটা আমি দেব। জনগণের বিশ্বাস ও যে পরিমাণ সমর্থন আছে, আমি মনে করি জনগণই এই ভোটে জিতবে।

ঢাকা-২০ আসনে এবারও নৌকার প্রার্থী ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা বেনজীর আহমদ।

[213654]

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ মালেক এবং ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা মোহাদ্দেছ হোসেন।

ঢাকা-১৬ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রবিন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা।

এদিকে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন গত উপনির্বাচনে জয়ী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত আশওয়াদ ইসলামও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

এছাড়াও ঢাকা-২ ও ঢাকা-৩ আসনে একজন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটে রয়েছেন।

দেশের ৩০০ নির্বাচনী আসনে ২৭টি দলের ১৫১৩ জন প্রার্থী রয়েছেন, এছাড়া ২২৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৩৮২ জন। আদালতে কয়েকটি মামলার নিষ্পত্তি হলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগ থেকে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তাতে সারাদেশেই অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যও রয়েছেন।

এমটিআই