ঢাকা : নির্বাচন জমিয়ে দেয়ার কৌশলে নৌকার প্রার্থীদের বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় ভোটের মাঠে বাড়ছে উত্তেজনা। প্রচার ঘিরে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আসতে থাকায় কঠোর হওয়ার বার্তা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
৩০০ আসনে প্রায় ১৯০০ প্রার্থী এখন ভোটের প্রচারে তৎপর। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ইতোমধ্যে আট দিন পার হয়ে গেছে, প্রচারের সময় বাকি আছে আর দশ দিনের মত।
বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে সমাঝোতা আর জোটের হিসাব নিকাশের মধ্যে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লড়াই হবে প্রায় দেড়শ আসনে। এর মধ্যে শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের দলীয় পদধারী।
নিজেদের শক্তি আর জনপ্রিয়তা দেখাতে গিয়ে এরই মধ্যে গোটা পঁচিশেক আসনে প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারে বাধা দেওয়া, মারধর, হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতার তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমে। পিরোজপুর ও মাদারীপুরে দুজনের মৃত্যুও হয়েছে।
ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় এ পর্যন্ত আড়াইশর বেশি শোকজ করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী অপরাধের জন্য এখন প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করা হচ্ছে।
[214013]
আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম-১৬ আসনের নৌকার প্রার্থী সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইসি। একই কারণে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল হাইসহ সেখানকার তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এবং বরগুনা-১ আসনের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে নোটিস দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, কেন তাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হবে না।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের বলেন, বিধি লঙ্ঘনের জন্য প্রথমে শোকজ, মামলা হচ্ছে, ডাকা হচ্ছে। এরপর নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে চরম ব্যবস্থা হিসেবে প্রার্থিতা বাতিলও করা হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানও গত শনিবার এ বিষয়ে হুঁশিয়ার করেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের। তিনি বলেছিলেন, প্রার্থিতা বাতিল হবে, কোনো না কোনো জায়গায় কারো না কারো, এইটুকু আভাস আমি দিয়ে রাখলাম।
সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তিন শতাধিক ওসি, দুই শতাধিক ইউএনওকে বদলি করা হয়েছিল আগেই। বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ায় কয়েকজন ডিসি, এসপি, ওসিকে আগের কর্মস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে গত কয়েক দিনে।
৭ জানুয়ারি ভোট সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ২৯ ডিসেম্বর থেকে মাঠে নামছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্রও জারি করা হয়েছে।
ভোটের মাঠের সংঘাত সহিংসতা নিয়ে ক্ষমতাসীনরাও যে বিব্রত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায় তা স্পষ্ট।
[214017]
মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নির্বাচন হলে আমাদের মত দেশে টুকটাক ঘটনা ঘটে। কিছু কিছু সহিংসতাও বেড়েছে। একটা বিষয় দুঃখজনক ও নিন্দনীয় যে দায়িত্বশীল নেতারা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলেন। এমপি ছিল, মন্ত্রী ছিল এমন লোকেরা এখনো ধমকের সুরে কথা বলে। এখনো ক্ষমতার দাপট যারা দেখায় তাদের মুখ বন্ধ করতে হবে।
নির্বাচনে ‘অসুষ্ঠু পরিবেশ’ যারাই সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন সরকারের এ মন্ত্রী।
সরকারের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনটা আমরা খুব ভালোভাবে করতে চাই। নির্বাচন নিয়ে বদনাম নিতে চাই না। শেখ হাসিনা একটা সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন সত্যিকার অর্থে চান। তার ইচ্ছেকে সার্থক করতে হবে।
ভোটের মাঠে যত হাঙ্গামা
ঝিনাইদহ-১: গত ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শৈলকূপা উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের রয়েড়া বাজারে এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নজরুল ইসলামের সমর্থকদের ওপর হামলা হয়। উদেমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাবদার হোসেন মোল্লাসহ তার পাঁচ কর্মী এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারাত্মক আহত করা হয়। এসব ঘটনায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের অনুসারীরা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
রাজশাহী-৬: এ আসনে লড়াই করছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা রায়হানুল হক। রায়হানের ছোটো ভাই নাজির হোসেনকে ২১ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকেরা নির্বাচনি কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে।
পিরোজপুর-১: এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম এ আউয়ালের ভাইয়ের ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানভীর মুজিব অভি, যুবলীগ কর্মী রনি দাস ও ছাত্রলীগ নেতা স্মরণ চক্রবর্তীর ওপর নৌকার সমর্থক বায়জিদ হোসেনের কর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। পিরোজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মল্লিক স্বপন বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম এ আউয়ালকে সমর্থন দেওয়ায় নেতা-কর্মীদের নানা রকম হুমকি ও মারধরের ঘটনা ঘটছে।
লক্ষ্মীপুর-২: এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের প্রচারে বাধা ও মাইক ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২৪ ডিসেম্বর সেলিনা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “ঈগল প্রতীকের প্রচারের সময় একদল সন্ত্রাসী গাড়ি ও মাইক ভাঙচুর করে। আমার কর্মীকে মারধর করে। বিষয়টি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।”
লালমনিরহাট-১: এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান প্রধানের গণসংযোগে হামলা, গাড়ি ও ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোতাহার হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামলকে শোকজ করে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। আতাউর রহমান প্রধান ২২ ডিসেম্বর রাতে হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী মেডিকেল মোড় এলাকায় গণসংযোগ করতে গেলে তার কর্মীদের ওপর হামলা হয়। সে সময় তার গাড়ি ও ক্যাম্প ভাংচুর করা হয়।
[214006]
বগুড়া-৪: এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মোল্লার ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেনের নামে মামলা হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। জিয়াউল হক তার লোকজন নিয়ে গণসংযোগে বের হলে উপজেলার তিনদীঘি বাজার এলাকায় বেশ কয়েকজন যুবক তার মাইক্রোবাসে হামলা চালায়। তাতে জিয়াউল হকসহ তার পাঁচ সহযোগী আহত হন।
ফরিদপুর-৩: এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে নৌকার প্রার্থী শামীম হকের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ২৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুরে ওই ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম-১২: পটিয়ায় নির্বাচনী প্রচারের সময় ২০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের হুইপ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর গাড়ি বহরে নৌকার প্রার্থী মোতহেরুল ইসলাম চৌধুরীর সমর্থকরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে।
কুমিল্লা-৭: এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুনতাকিম আশরাফ টিটুর সমর্থক চান্দিনা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানসহ চারজনকে কুপিয়ে জখম করা হয় ২৫ ডিসেম্বর। এ ঘটনায় নৌকার সমর্থকদের দায়ী করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
চাঁদপুর-২: গত ১৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার অনুসারীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এম ইসফাক আহসান।
কুমিল্লা-৪: আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী এক ছাত্রলীগ নেতার ওপর হামলা হয় ১৪ ডিসেম্বর। স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
টাঙ্গাইল-৫: নৌকার প্রার্থী মামুন অর রশিদ মামুনের মিছিলে গুলি চালানোর ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পিরোজপুর-১: পিরোজপুর সদর উপজেলায় ‘দুর্বৃত্তদের হামলায়’ স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম এ আউয়ালের সমর্থক এক যুবক মারা গেছেন ১২ ডিসেম্বর।
ঢাকা-১৯: গত ২১ ডিসেম্বর এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা এবং তার কর্মীদের মারধর করার অভিযোগ ওঠে নৌকা প্রার্থী এনামুর রহমানের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
বগুড়া-৪: কাহালু উপজেলায় নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে ২৪ ডিসেম্বর হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম।
শরীয়তপুর-২: নড়িয়ায় ২ ডিসেম্বর নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় থানায় মামলা করা হয়।
রাজশাহী-৪: গত ২৫ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী ও টানা তিনবারের সংসদ সদস্য প্রকৌশলী এনামুল হকের গাড়িবহরে হামলার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার জন্য নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের সমর্থকদের দায়ী করা হচ্ছে।
ঢাকা-১৩: এ আসনে ২৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবীর নানকের ভোটের প্রচারে থাকা কর্মীদের ওপর হামলা করে থানা ছাত্রলীগের এক নেতা। পরে তাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
নওগাঁ-৪: এ আসনে ২৩ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম ব্রহানী সুলতান মামুদ গামার নির্বাচনি কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে নৌকার প্রার্থী নাহিদ মোর্শেদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তিনজন আহত হন।
চুয়াডাঙ্গা-১: গত ২৫ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী দিলীপ কুমার আগরওয়ালকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে নৌকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় মামলা হলে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মানিকগঞ্জ-২: এ আসনে ২৫ ডিসেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আবিদ হাসান বিপ্লবের সঙ্গে কথা কাটাকাটির জেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর সমর্থককে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের হয়ে এ আসনে তৃতীয়বারের মত নির্বাচন করছেন কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম।
মাদারীপুর-৩: মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় গত ২২ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী তহামিনা বেগমের কর্মী ও লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এসকানদার খাঁয়ের (৫০) ওপর হামলা হয়। হাতুড়ি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করা হয় তাকে। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এমটিআই