ঢাকা : দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আওয়ামী লীগে দলাদলি, কোন্দল তুঙ্গে উঠেছে। তৃণমূলে সংগঠন দুর্বল হয়েছে। প্রায় ১০ বছর পর দলটির নীতিনির্ধারকদের এমন উপলব্ধি হয়েছে।
তারা বুঝতে পেরেছেন স্থানীয় রাজনীতিতে দলাদলি-বিরোধ ও কোন্দলের মূলেই রয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক দেওয়া।
এ কারণে আসছে উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন থেকে বিরত থাকবে। দলীয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এই পর্যায়ে এসে কেন এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে জানতে চাইলে দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক বলেন, ‘নির্বাচন বিতর্ক থেকে দূরে থাকা এবং দলীয় বিরোধ নিষ্পত্তি করার কৌশলে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ।’
২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে ভোটের বিষয়টি যুক্ত করা হয়।
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতকাল নির্বাচন কমিশনার আলমগীর বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল যদি মনে করে দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন দেবে না, সেই সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো মন্তব্য নেই। সমস্যাও নেই। আইন অনুযায়ী, দুইভাবে মনোনয়ন দেওয়ার নিয়ম আছে। রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন বা স্বতন্ত্র।’
একই দিন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামও বলেছেন, কোনো দল যদি প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করতে চায় তাতে আইন সংশোধনের দরকার হবে না।
গত সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনেই কাউকে আর প্রতীক বরাদ্দ দেবে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন যে ক্ষতির কারণ হয়েছে, তা সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও টের পাওয়া গেছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান। তারা বলেন, একাধিক জেলায় দলের নেতাকর্মীরাই নৌকা হারাতে চেষ্টা করেছেন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, দেশে যেকোনো নির্বাচন হলেই একধরনের সমালোচনা-বিতর্ক শুরু হয়। দেশে-বিদেশে একটি মহল সমালোচনা শুরু করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে। এই মেয়াদে ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী বিতর্ক সৃষ্টি হোক তা চান না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা হলে সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি করার সুযোগ পাবে না বিরোধীরা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও আমলে নেওয়া হয়েছে বলে জানান এই নেতা।
[216187]
দলটির প্রবীণ নেতা টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক দিয়ে নির্বাচন ঠিক হয়নি। এতে তৃণমূলের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে যখন দেওয়াই হয়েছে, দিয়ে আবার এখন দেব না, এটাও ঠিক হয় নাই।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, রাজনীতি না করেও তৃণমূলে জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়া সহজতর করে দিয়েছে প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুযোগ সৃষ্টি করে। আর্থিক সুবিধার আদান-প্রদান করে রাজনীতির মাঠে স্লোগান না দিলেও ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন টাকাওয়ালারা। আওয়ামী লীগেরই কোনো না কোনো পর্যায়ের নেতারা টাকাওয়ালাদের এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিচ্ছে না বলে মনে করেন দিনাজপুরের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা।
দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, অনুপ্রবেশের সুযোগও করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি। অনুপ্রবেশ বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং ঘটেছে ২০১৪ সাল থেকেই। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রাজনীতি করেননি কিন্তু দলীয় সংসদ সদস্যের আশীর্বাদপুষ্ট তিনি, এই পরিচয়েও স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন জুটে যাচ্ছে। এই অনিয়মের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরাও জড়িয়ে যান আর্থিক সুবিধা নিয়ে। অর্থ বিনিময়ের কারণে ত্যাগী, আদর্শবান নেতারা বঞ্চিত হয়েছেন। এতে করে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, এমন উদাহরণ অসংখ্য।
ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা বলেন, নিষ্ক্রিয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের আবার সক্রিয় করার জন্য প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন, ২০১৫ আইন কাগজে-কলমে রেখে পুরনো নিয়মেই ফিরে গেছে আওয়ামী লীগ।
এই নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। প্রতীকে নির্বাচন না হওয়ার কারণে বিএনপির কোনো নেতা চাইলে নির্বাচন করতে দলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে না। দলের অনুমতিও লাগবে না।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছি বিএনপিসহ তাদের সঙ্গে যারা আছে, তারা এ নির্বাচনে (স্থানীয় সরকার) আসবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকে আরও প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর করার চেষ্টা থেকে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলের অভ্যন্তরে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে সেটিও দূর হবে বলে মনে করেন তিনি।
এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘প্রতীক দেওয়ার কারণে অনেক কর্মী হতাশ হয়ে রাজনৈতিক মাঠ থেকে সরে গেছেন। আবার অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তি প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। এ জন্য প্রতীক না দেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত।’
খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, ‘উন্মুক্ত করে দেওয়ার কারণে বেশি প্রার্থী হবে না। যোগ্য ও জনপ্রিয়রাই প্রার্থী হতে পারবেন।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই