ঢাকা : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ কী— তা নিয়ে খোদ শরিকরাও শঙ্কিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ছাড় পেলেও তারা জিতেছে মাত্র দুটিতে। বিপর্যয় ঘটেছে দলের শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েটদের।
শরিক দলের নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নৌকা প্রতীক দিলেও স্বতন্ত্রদের পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সমর্থনের কারণে ছিটকে পড়তে হয়েছে তাদের।
অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর ২৩ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। এরপর থেকে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠন নীতি নিয়ে দুই দশকের বেশি সময় একই পথে হাঁটছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই জোট।
তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগত রাজনীতিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। দরকষাকষির পর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ৬টি আসনে ছাড় পেলেও জয় পেয়েছে মাত্র দুটিতে। বাকি চারটি আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ধরাশয়ী হতে হয়েছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল হক ইনু, ফজলে হাসান বাদশার মতো দলের শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েটদের।
আবার শরিকদের এমন পরিণতির জন্য শুধু আওয়ামী লীগকেই নয়, ১৪ দলের কিছু কিছু দলের দিকেও অভিযোগের তীর জোটের কোনো কোনো নেতার। তাদের দাবি, শরিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় থাকলে আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারত না।
জোটের একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগত রাজনীতিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। অনেক দরকষাকষির পর আওয়ামী লীগ জোটকে মাত্র ছয়টি আসনে ছাড় দিয়েছে। শরিক দলগুলোর প্রত্যাশা বেশি থাকলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ।
এমনকি বিগত নির্বাচনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী হওয়া জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ও বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীসহ অতীতে জোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত কাউকে কাউকেও এবার আসন ছাড় দেওয়া হয়নি। শরিক ১৪ দলের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে দুটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ) তিনটি এবং জাতীয় পার্টিকে (জেপি) একটি আসনে ছাড় দেওয়া হয়।
৬টি আসনে ছাড় দিলেও নির্বাচনের মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীদের পাশে ছিল না। কেন্দ্র থেকে সেটা নিবৃত্ত না করার কারণে তারা আরও উৎসাহিত হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বাইরে সাংগঠনিক সামর্থ্যরে দিক থেকে এগিয়ে থাকা দলগুলো সব সময় নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এখন অন্যদের পাশাপাশি সেই দলগুলোও ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন তারা সংরক্ষিত নারী আসন ও মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার প্রত্যাশায় প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। তাদের প্রত্যাশা পূরণ না হলেই আওয়ামী লীগের সমালোচনা শুরু করবেন। এই অবস্থায় শরিক দলগুলো বর্তমানে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের মধ্যে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। জোটের ঐক্য অটুট রাখা নিয়ে শরিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত না থাকলেও দলীয় ও জোটগতভাবে বসে মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নিতে চায় তারা।
এ প্রসঙ্গে ফজলে হাসান বাদশা বলেন, অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক দিলেও তাদের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। তারা বলেছে, নৌকা প্রতীক পেলেও তারা (জোটের অন্য দলের নেতারা) আওয়ামী লীগের কেউ না।
দলের অবস্থান জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা শিগগির দলীয়ভাবে বসে এগুলোর মূল্যায়ন করব। এরপর জোটের বৈঠকেও এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা হবে।
এবারের নির্বাচনে নৌকা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন শেষ করে সবে সরকার গঠন হলো। শিগগির আমরা নিজেদের দলের বৈঠক আহ্বান করে আগে দলীয়ভাবে মূল্যায়ন করব, এরপর জোটের সঙ্গে বসে পরবর্তী মূল্যায়ন হবে।
অতীতে নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এবার জোটের মনোনয়ন পাননি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে এবার জোটের আসন পাওয়া এবং পেলেও জয়ী হতে না পারার মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে যে আদর্শ নিয়ে এই জোট গঠন হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তা এখনো রয়েছে বলে আমি মনে করি। জোট নিয়ে কী হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করছে আমাদের জোট নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
জোটের ভবিষ্যৎ কী জানতে চাওয়া হলে শরিক দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়া বলেন, জোটের কার্যক্রমের ছন্দপতন এবং মান-অভিমান হলেও ১৪ দলের প্রয়োজনীয়তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তবে জোট থাকবে কি না তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ওপর।
জোট শরিকদের ক্ষোভ কাটাতে আওয়ামী লীগ শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করবে কি না বা বৈঠকে বসার চিন্তা করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে মহানগর ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, নির্বাচন শেষ হয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে মাত্র। এখনো সংসদ অধিবেশনও শুরু হয়নি। আমরা একটু সময় নিয়েই বসব। সেই বৈঠকে সব বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হবে।
২০০৫ সালে ২৩ দফার ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলোকে নিয়ে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে সরব উপস্থিতির মধ্য দিয়ে শুরু হয় জোটের কার্যক্রম। ২০০৮ সালের পর থেকে গত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে শরিকরা জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে ১৪ দলীয় জোটের অংশীদারত্ব ছিল। সেই সময় জোটের অন্তত একজন টেকনোক্র্যাটসহ চারজন নেতা মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জোট শরিকদের কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। নির্বাচনে শরিকদের জন্য আসন বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্ব হারায় আওয়ামী লীগের কাছে। সেই ধারাবাহিকতা এবারও অব্যাহত রাখে আওয়ামী লীগ। কেউ কেউ এমনও বলছেন, যে আদর্শ নিয়ে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল, সেই আদর্শের আর প্রয়োজন বোধ করছে না আওয়ামী লীগ। যার কারণে রাজনৈতিকভাবে তাদের গুরুত্ব হারিয়েছে জোটের শরিক দলগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এমন মনোভাবের কারণে এবার আসন ছাড় নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের অন্তত ছয় মাস আগে থেকেই ১৪ দলীয় জোটের একটি দলের প্রধান নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসতে বাকি দলগুলোকে বারবার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে আলোচনায় বসার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি জোটের শীর্ষ নেতারা।
বিশেষ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা নিজেদের প্রত্যাশিত আসন ছাড়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকার কারণে সেটা হয়নি। এমনকি ওই নেতার এমন মনোভাবের কথা আওয়ামী লীগের কাছে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছিল। অন্য অনেক কারণের পাশাপাশি সেই নেতাকে জোটের মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে এটি কাজ করেছে বলেও অনেকেই মনে করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেন, আমাদের জোটের কিছু কিছু দলের শীর্ষ নেতারা শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়ে বেশি সোচ্চার। নিজেরা সুবিধা পেয়ে যাওয়ার পরেই তারা আবার নীরব ভূমিকা পালন করে আসছেন। তারা জোট নিয়ে সেভাবে ভাবেন না। সেভাবে ভাবলে আজকে জোটের এই অবস্থা হতো না। আওয়ামী লীগও আমাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হতো। নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ের ঘাটতির সুযোগ নিয়েছে প্রধান দল আওয়ামী লীগ।
তিনি আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কিছু কিছু দলের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বের হওয়া কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)- এই দল দুটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে বেগ পেতে হবে দল দুটির শীর্ষ নেতাদের।
জোট-সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি, পরে নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো নিজেরা আগে আলাদা বৈঠক করবেন। সফলতা-ব্যর্থতার বিষয়টি নিজেরা মূল্যায়ন করবেন আগে।
এরপর ১৪ দলগতভাবেও বৈঠকে বসবেন তারা। সেখানে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
জোটের প্রার্থীদের পাশে সকল শরিক দলের উপস্থিতি কেমন ছিল, এর মধ্যে কারা কারা সহযোগিতা করেছেন আর কারা অসহযোগিতা করেছেন তার একটা মূল্যায়ন করা হবে। সামনের দিনে রাজনীতিতে জোটের গুরুত্ব এবং শরিক দলগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগের ভাবনার বিষয়টিও জানতে চাওয়া হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
এমটিআই