ঢাকা: চলচ্চিত্রের আতুর ঘর বলা হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনকে (বিএফডিসি)। একটা সময় ছিলো যখন রাত-দিন সব সময় প্রাণবন্ত থাকতো এফডিসি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই চিত্র আজ অনেকটাই উল্টে গেছে। আগের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণতো দূরের কথা দালালদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন লোকেশন থেকে শুরু করে ফ্লোর, এসি, লাইট, ক্যামেরা এই দালালদের কাছ থেকেই ভাড়া নিতে হয়। আর তাদের ব্যবহার করে পকেট ভরছে এফডিসির কিছু অসাদু কর্মকর্তা।
জানা গেছে, বাংলাদেশে এফডিসিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অভিনয় শিল্পীর চেয়ে এখানে কর্মচারী বেশি। কিছুদিন আগে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে একই পরিবারের ৯ জনের চাকরি দেয়ারও অভিযোগ উঠেছিলো। এমনকি শুটিং করতে এফডিসির সরঞ্জাম সরাসরি না পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে দ্বারস্থ হতে হয় তৃতীয় পক্ষের। যাতে গুনতে হয় তিনগুণ টাকা। আবার বকশিস ভোগান্তিতো রয়েছেই।
[217610]
করিম চাচা (ছদ্মনাম) নামে একজন ১৯৮০ সাল থেকে এফডিসিতে কাজ করেন। তার ভাষ্যমতে, বর্তমানে ছবির কাজ কম তাই ফ্লোরগুলোতে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর কাজ বেশি হয়। সেখানেই প্রয়োজন পড়ে এসির। যা ভাড়া নিতে হয় প্রোডাকশন ম্যানেজার দেলোয়ার আর স্বপন নামের এক দালালের মাধ্যমে। তারা মূলত এফডিসির কিছু কর্মকর্তার সাথে চুক্তি করে এসি এনে ভাড়া দিয়ে থাকে।
তিনি আরও জানান, বেসরকারি টেলিভিশনগুলো এই দুইজনের কাছ থেকে তিন কিস্তিতে এসি ভাড়া নিয়ে থাকে। প্রথম কিস্তির ৩০ হাজার টাকা তিন দিনে, দ্বিতীয় কিস্তির ৬০ হাজার টাকা ৬ দিনে এবং তৃতীয় কিস্তির ৯০ হাজার টাকা ৯ দিনে নিয়ে থাকেন তারা। এছাড়াও ১ মাসের প্যাকেজও দিয়ে থাকেন তারা। আবার মিউজিক ভিডিওর শুটিং করতে গেলে একদিনে এসির ভাড়া বিভিন্ন তাল বাহানায় দিতে হয় দেড় লাখ টাকা। সঙ্গে আছে বিদ্যুৎ বিলও।
এফডিসির বিশ্বস্ত একটি সূত্র বলছে, যে এসিগুলো ভাড়া দেয়া হয় সেগুলো এফডিসির নয়, বাইরে থেকে ভাড়া করে আনা। এফডিসি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসি নিলে বিদ্যুৎবিলসহ ৮ টনে পার শিফটে ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার ২৩০ টাকা। সেখানে দালালরা পার শিফট ৫ টনে নেন ১০ হাজার টাকা।
[217582]
এ বিষয়ে জানতে সোনালীনিউজের পক্ষ থেকে ফোন দেয়া হয় স্বপনকে। পরিচয় গোপন করে একটি মিউজিক ভিডিওর শুটিং করার কথা বলা হয়। স্বপন দেখিয়ে দেন তার বন্ধু দেলোয়ারকে। তিনি এসির খরচ বাবদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার হিসাব দেন। সেই সঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিদ্যুৎ খরচের কথা জানান। তাদের হিসেবে শুধু ২ নম্বর ফ্লোরে দুই শিফটে পার টন এসির খরচ দাঁড়ায় ১৮০০ টাকা। যেখানে বর্তমান সময়ে সিনেমা করে লোকসান গুনছেন প্রয়োজকরা সেখানে শুধুমাত্র এসির পেছনে এতো টাকা খরচ করে কেন এফডিসিতে শুটিং করতে যাবেন তারা।
এদিকে কেঁচো খুরতে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। জানা যায়, এসবের মূলহোতা এরশাদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি ৫০ হাজার টাকায় একটি প্রোডাকশন হাউজ খুলে নিবন্ধন করে নিয়েছেন এফডিসিতে। সেটি ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে ৬ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি। তার পরামর্শেই এফডিসিতে অপকর্মে লিপ্ত দালালরা।
এফিডিসির সিনিয়র ক্যামেরা পার্সন আলিম সোনালীনিউজকে বলেন, ‘এরশাদের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এফডিসির এক ক্যামেরার ভাড়া ১১ হাজার টাকা। কিন্তু সেটি তার কাছ থেকে ১৩ হাজার টাকায় নিতে হয়।’
এদিকে এফডিসিতে শুটিং করতে গেলেই ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এক্ষেত্রে আবার বিভিন্ন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের পেছনে ঘুরতে হয়। আর সেই সুযোগটিই কাজে লাগান এরশাদ। এ কারণেই এফডিসির প্রতি বাইরের মানুষের খারাপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। শুটিং করা থেকেও বিরত হচ্ছে।
[217648]
এরশাদের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিরেক্টর প্রোডাকশন কর্মকর্তা রেজাউল হক তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। উল্টো প্রশ্ন করেন আপনি কে? সঙ্গে এও জানান, এফডিসিতে কোনো ধরনের ভিডিও করতে হলে টাকা গুনতে হবে এমনকি এফডিসির নিবন্ধনের আওতায় আসতে হবে। অথবা এমডি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। এমডি অনুমতি দিলে তবেই এরশাদের বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে।
তবে অন্যরা বলছেন, এই এরশাদের সঙ্গে এফডিসির উর্ধ্বতন গুটি কয়েকজন জড়িত আছেন। শুধু তাই নয় কোন ছুটির দিনে শুটিং করতে হলে সেই এরশাদই উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিয়ে শুটিং করারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এর আগে এক সাক্ষাৎকারে লেখক ও গবেষক মির্জা তারেকুল কাদের জানিয়েছিলেন, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অদক্ষতায় এফডিসির এমন বেহাল দশা হয়েছে। এখন শুধু এফডিসির প্রাণটা আছে, সেটাও কবে নিভে যাবে কে জানে! এখন এফডিসির আর কোনো ভিশন নেই। আক্ষেপ করে এই গবেষক জানিয়েছিলেন, গবেষণায় এফডিসির বিভিন্ন দুর্নীতির কথা তুলে ধরায় সেখানে যাওয়াই তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠানের গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে তার গুরুত্ব বুঝতে হবে। কিন্তু সে সময় আর আছে বলে মনে হয় না।
ওয়াইএ