ঢাকা: সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বুধবার (১০ জুলাই) তাদের এই কর্মসূচিতে রাজধানীসহ গোটা দেশ কার্যত অচল হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকেলেও এই কর্মসূচি চলবে।
চলমান এই আন্দোলনে গত শনিবার (৬ জুলাই) নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন 'বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন' এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
[227373]
তার এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ প্রথমবার এই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের সাথে পরিচয় হয়। এ সম্পর্কে কোটা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, ‘বাংলা ব্লকেড মানে হলো, সারা দেশে আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট অবরোধ করবো, যাতে কোনও গাড়ি চলতে না পারে। শহরের যান চলাচল ব্লক করার জন্য আমরা সম্ভাব্য সব রুট অবরোধ করবো। যদি জানতে পারি কোনও বিকল্প রুটে বাইপাস দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, সেটিও অবরোধ করবো।’
নতুন এই রাজনৈতিক হাতিয়ার ‘বাংলা ব্লকেড’কে অনেকটা হরতালের ভিন্ন রূপ মনে হতে পারে। যদিও দেশে হরতালের রাজনীতি বা হরতাল শব্দটি এখন অঘোষিত নিষিদ্ধ বলা যায়! হরতাল মানেই রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে গাড়ি ভাঙচুর, বোমা নিক্ষেপ, অগ্নিসন্ত্রাসের মতো ন্যাক্কারজনক পন্থা মানুষ ভালো চোখে দেখে না বলেই হয়তো এখন আর সেরকম কর্মসূচি দেয়া হয় না।
সাধারণ মানুষ আশা করছেন, ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের নতুন এই কর্মসূচি গণমানুষের দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হবে, কখনোই হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে না।
[227363]
বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম অবরোধ বা হরতাল শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী বন্ধ বা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে হরতালকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রূপ দেন।
কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশে হরতাল জনগণের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের একটি পন্থা হয়ে ওঠে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব যে সব আন্দোলন হয়েছে যার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সফলতা, ৬৬ এর ছয় দফাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ১৯৬৯ এর অসহযোগ আন্দোলনের সফলতা, ৭০ এর নির্বাচনের অধিকার ফিরে পাওয়া অথবা সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপ রেখা অঙ্কিত হয়েছে হরতালের মতো আন্দোলনের মাধ্যমে।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে বিভিন্ন দাবি আদায় নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন দেখা দেয় রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সমস্ত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে গণতন্ত্র ফিরে পাবার জন্য ৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার আন্দোলন, একই ভাবে ২০১৪ সাল থেকে বিএনপি একই দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এখনো আন্দোলনরত, ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলামের ১৩ দফা দাবি আদায়ে লং মার্চ অথবা ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তৈরি গণজাগরন মঞ্চ। রাজনৈতিক দলের এসব আন্দো্লন নদীর মত প্রবাহমান। ভিন্ন ভিন্ন সময় এক এক নামে উপস্থাপিত হয়।
[227348]
এসব আন্দোলনের সাথে সাথে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের চাকুরির বয়স বৃদ্ধির আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বা ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন আবরণে আরেক নাম ‘বাংলা ব্লকেড’।
এদিকে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর বুধবার এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। এ আদেশের ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, আমরা কোনো ঝুলন্ত সিদ্ধান্ত মানতেছি না। আমাদের এক দফা দাবি, সংসদে আইন পাস করে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম (সর্বোচ্চ ৫শতাংশ) কোটা রেখে সকল ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করতে হবে।এ দাবি নির্বাহী বিভাগ থেকে যতক্ষণ না পূরণ করা হবে আমরা রাজপথে থাকব।
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। তার মাঝে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বাকি কোটার মাঝে ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ কোটা ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের।
ওই বছরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল যে কোটা ৫৬ শতাংশ না হয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। তাদের দাবির মুখে সে বছর পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
কিন্তু ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাবার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং গত পাঁচই জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। তারপর হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার সকালে কোটার পক্ষের এক আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি করেনি আদালত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত না করায় পূর্বের নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আপাতত বহাল রয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের পর গত ৬ জুন থেকেই তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। মাঝে কিছুদিন আন্দোলন চললেও ঈদুল আজহার কারণে ২৯ জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন ৩০ জুন থেকে ফের আন্দোলন শুরু করেন তারা।
আইএ