ঢাকা : সদ্য বিদায়ী আওয়ামী শাসনামলের ১৬ বছরে শুধু রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি বঞ্চিতদের তালিকাও হয়েছে দীর্ঘ। কথিত তদন্ত প্রতিবেদনে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকায় পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অনেকেই বিষণ্নতায় ভুগেছেন। তাদের মধ্যে কাজ করেছে একবুক হতাশা । দীর্ঘ চাকরি জীবনে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তাদের জোটেনি পদোন্নতি। প্রায় গত দেড় দশকের বেশির ভাগ সময় তাদের ওএসডি থাকতে হয়েছে অথবা ডাম্পিং স্টেশনে ফেলে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক লেবেল এঁটে অনেককে বাড়িও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া মনের যাতনা নিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের অধীনে কাজ করছেন অনেকেই। অবশেষে কাটতে শুরু করেছে ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের এই মর্মপীড়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর বিভিন্ন সময়ে বঞ্চিত ১৯ কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ১০টার মধ্যে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন দেড় দশক ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তারা।
[229075]
তারা জনপ্রশাসন সচিবের কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে তাকে না পেয়ে যান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দফতরে। সেখানে সচিবকে না পেয়ে এরপর তারা সচিবালয়ের লাইব্রেরিতে সভার আয়োজন করেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া। সভা সঞ্চালনা করেন ১৩তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: মাহবুবুর রহমান।
বক্তব্য রাখেন ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. আব্দুস সবুর, ৮৫ ব্যাচের জাকির হোসেন কামাল, ৮৪ ব্যাচের ওয়াহিদ জামান, ১৩তম ব্যাচের মাহফুজুর রহমান, ১১তম ব্যাচের এহসানুল হক, ২০তম ব্যাচের মির্জা আলী আশরাফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রটোকল অফিসার মো: ফরিদুল ইসলাম, ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস সুরুতুজ্জামান, ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম, ২৪ ব্যাচের নুর জাহান খানম, বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব তোয়াহা মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম।
সভায় অংশ নেয়া সিনিয়র কর্মকর্তারা বঞ্চিত সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, যে যেখান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, ঠিক সেখান থেকেই ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেয়া হবে। তবে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করবেন না। কারণ আমরা এমন কোনো আচরণ করব না যাতে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ভুল বোঝে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাতিল করে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ভাতা চালুর ঘোষণা দেন তারা।
[229076]
১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা এহসানুল হক বলেন, আজ পাওয়া না পাওয়ার হিসাবের দিন নয়। আজ হচ্ছে মিলনমেলা। যে সাথীদের বছরের পর বছর দেখিনি, যারা বুকভরা বেদনা দিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। যাদের কথা বলার কিংবা বসার কোনো জায়গা সচিবালয়ে ছিল না তাদের মুখগুলো দেখতে এসেছি। আজ আমরা একটু হালকা হওয়ার জন্য মিলিত হয়েছি। পাওয়ার হিসাব পরে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, চারদিন আগেও দেখেছি যারা দালালের সাথে ঘুর ঘুর করেছেন, তাদের অনুরোধ করব নিজ দায়িত্বে এখান থেকে সরে যান। যারা বঞ্চিত কর্মকর্তা কর্মচারী তাদের নাম, পদবি, কতবার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছে তার ডেটাবেজ আমাদের কাছে আছে। প্রতি সপ্তাহে আমরা তালিকা রিভিউ করি। কেউ মনে করবেন না, আপনারা বঞ্চিত বললেই তা আমরা মেনে নেবো।
তিনি আরো বলেন, সব শহীদ পরিবার, আহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমরা নতুন প্রজন্মের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থা করব। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাতিল করব। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করব। যারা জীবন দিয়ে আমাদের মুক্তি দিয়ে গেছেন, কর্মদিয়ে আমরা তাদের ঋণ শোধ করব। তারাই প্রকৃত বীর। তারা আমাদের ওপর থেকে জগদ্দল পাথর সরিয়ে দিয়েছে সেই শহীদ ছাত্ররাই হচ্ছে আসল বীর।
বিগত ১৬ বছরে যারা মামলা খেয়েছেন, ওএসডি হয়েছেন, পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন, বিভাগীয় মামলা খেয়েছেন, জুনিয়রদের অধীনে চাকরি করেছেন এবং অন্যরা দোষ করে যাদের ওপর চাপিয়ে চাকরিচ্যুত করেছে, তাদের সব ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে। যে যেই তারিখ থেকে সুপারসিটেড হয়েছেন, তাদে সেই তারিখ থেকে সিনিয়রিটি দেয়া হবে।
[229073]
এ দিকে সরকার পতনের পর বিভিন্ন সময়ে বঞ্চিত ১৯ কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ বদলির আদেশ দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিয়োগ শাখার উপসচিব কানিজ ফাতেমা স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তাগণকে তাদের নামের পাশে বর্ণিত পদে বদলিপূর্বক নিয়োগ করা হলো। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
যাদের পদায়ন করা হয় তারা হলেন, ১১তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব ড. খ. ম. কবিরুল ইসলাম, ১৩তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ১৫তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: বাবুল মিঞা, ১৭তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: ইউনুছ আলী, ১৭তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব এ কে এম তরিকুল আলম, ১৭তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: আব্দুর রহমান তরফদার, ১৭তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব কানিজ মওলা, ১৭তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: সলিমুল্লাহ, ১৭তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: ফিরোজ সরকার, ১৮তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: ফজলুর রহমান, ২০তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ২০তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব কে এম আলী আযম, ২৪তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মু: বিল্লাল হোসেন খান, ২৪তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব নুরজাহান খানম, ২৪তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: জসিম উদ্দীন, ২৪তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব হোসনা আফরোজা, ২৪তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ সাইফুল হাসান, ২৫তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব ফরিদা খানম, ২৫তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: সগীর হোসেন।
এমটিআই