ঢাকার ট্রাফিকের একাল-সেকাল

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৪, ১১:২৭ এএম

ঢাকা : আশির দশকে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান ছিল, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’। তবে হাল আমলে এই গানের মতো ঢাকায় এসে আর কারও আশা ফুরানোর উপায় নেই।

ঢাকা এখন যানজট, ময়লা আর মানুষের ভিড়ের শহর। প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমাহার নেই, আছে কংক্রিট আর ধুলোবালির আস্তরণ।

ইতিহাসবিদরা বলেন, অতীতকালে ঢাকা ছিল মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের শহর। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়া এই শহরের বুকচিড়ে অসংখ্য খাল এঁকেবেঁকে চলে গেছে বিভিন্ন প্রান্তের নদীর কোলে। সেখান দিয়ে চলাচল করতো নৌকা। তবে শহরে সড়কও কম ছিল না।

[233133]

এক সময় ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত লোকদের বসবাস ছিল হেয়ার স্ট্রিট, ওয়ারস্ট্রিট, স্বামীবাগ। ব্যবসায়ী ও ঘনবসতির লোকজন বাস করতো শাঁখারিপট্টি, তাঁতিবাজার, ঠাটারিবাজার, ইসলামপুর ও তৎসংলগ্ন গলিতে।

আর অতীতে ঢাকার প্রধান রাস্তা ছিল নবাবপুর, ইসলামপুর এবং অন্যান্য কিছু রাস্তা যেমন- সদরঘাট, বাংলাবাজার, চকবাজার, হাজারীবাগ। অবাক করা বিষয়, ঢাকার কোনো রাস্তায়ই ফুটপাত ছিল না; এমনকি প্রধান রাস্তা নবাবপুরেও না।

তখন যানবাহন ছিল প্রধানত ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, কিছু বাস আর হাতেগোনা কয়েকটি কালো গাড়ি। প্রধান পরিচিত জায়গা ছিল সদরঘাট। উত্তরে রেল লাইনের পরে তেমন কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান ছিল না। স্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। তবে তখন শহরে মানুষ কম ছিল, কম ছিল যানবাহনও। তবে কখনও কখনও যানজট যে লেগে যেতো না তা-ও না; কিন্তু তা নিরসনে ছিল না কোনো ট্রাফিক সিস্টেম বা পুলিশ। অটোমেটিক পদ্ধতিতে সেই জ্যাম ছুটে যেতে।

ইতিহাসবিদদের বই ও প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় যানজট ছিল না। তাই ট্রাফিক সিস্টেম বলেও কিছু ছিল না। পাকিস্তান আমলে ঢাকা পৌরসভার অধীনেও তেমন কোনো ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ ছিল না। তবে জনবসতি ও বড় বড় মার্কেট এলাকায় কিছু লোক নিয়োগ করতেন ঢাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বররা। তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ হতো ঢাকার যানজট।

[232668]

জানা যায়, প্রায় তিন শতাব্দী আগে ১৭২২ সালের তৎকালীন লন্ডনের মেয়র তিনজনকে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেন। লন্ডন ব্রিজে যানবাহনের সুশৃঙ্খল চলাচল ও ওই সড়কের বাম দিকে যান চলাচল নিশ্চিত করার জন্য তিনজনকে নিয়োগ করেছিলেন। সেখান থেকেই মূলত ট্রাফিক পুলিশের যাত্রা শুরু। তার পর নদীর জলে গড়িয়েছে অনেক, আর পৃথিবী কয়েক হাজার বার পরিক্রম করেছে সূর্যের চারদিকে। বর্তমানে সারাবিশ্বের বড়-ছোট যে কোনো শহর ট্রাফিক ব্যবস্থা ছাড়া ভাবাই যায় না।

১৯৭৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশ গঠন করা হয়। এর পরই মূলত অফিসিয়ালভাবে ঢাকায় যানজট সামলানোর জন্য ট্রাফিক বিভাগ চালু হয়।

এ ছাড়াও দেশের বড় বড় মহানগরীর মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনেও শুরু হয় ট্রাফিক বিভাগ। তার পর ধীরে ধীরে আজকের অবস্থা।

মূলত আশির দশক থেকে ঢাকা শহর মহানগরী হয়ে উঠতে শুরু করে। এই সময় থেকে ঢাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে যানবাহন। আর বর্তমানে এমন পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে যে, ট্রাফিক পুলিশ বা অটোমেটিক স্বয়ংক্রিয় কোনো ব্যবস্থাই ঢাকার রাস্তার যানজটের সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারছে না।

[232342]

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় অসহনীয় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। রাজধানীর ৭৩টি মোড়ে আটকে যাচ্ছে যানবাহন। এতে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় শত কোটি (৯৮ হাজার কোটি) টাকা। আর জ্বালানি পুড়ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। একই সঙ্গে যানজটে বসে বসেই হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। বহুদিন সিসাযুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে আসে, কিডনি, হৃদযন্ত্র, প্রজননতন্ত্রের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

এর সমাধান কী- এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া মুশকিল। তবে বিগত সরকারের আমলে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় দুই স্কুলশিক্ষার্থী। আন্দোলনে নামে দেশের সব স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে তারা নিজ হাতে তুলে নেয় ঢাকাসহ দেশের পুরো ট্রাফিক সিস্টেম। তাদের অতুলনীয় কর্মদক্ষতা আর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দেশের পুরনো বিকল ট্রাফিক ব্যবস্থাকে কটাক্ষই করেনি; নতুন করে দিশা দিয়েছে। তবে একটি প্রবাদ আছে- যেই লাউ সেই কদু। শিক্ষার্থীরা সড়ক ছেড়ে বই নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে গেলে ঢাকার ট্রাফিক আবার পুরনো রূপে ফিরে আসে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সারাদেশে অব্যবস্থাপনার রাজত্ব শুরু হয়। পুলিশ কাজ থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এবারও শিক্ষার্থীরা ঢাকাসহ সারাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামেন। তারা প্রায় ২০-২৫ দিন দেশের ট্রাফিক সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখেন। তার পর ধীরে ধীরে তারাও ফিরে যান। আবার শুরু হয় সেই পুরনো অধ্যায়।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যানজটকে অগ্রাধিকার সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন এবং ঢাকাসহ সারাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন।

[232340]

জানা গেছে, সংকট নিরসনের রূপরেখা খুঁজতে দেশি ও স্বল্প খরচে সমাধানের পথে হাঁটতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। উপায় খুঁজে বের করতে প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব দেন বুয়েটের দুই বিশেষজ্ঞকে। এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ছয় দফা প্রস্তাবনা। পরিকল্পনা আছে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে হাইকোর্ট মোড় থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে কার্যকরের। এই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখভালের মূল দায়িত্ব পালন করবে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ আর বাস্তবায়নে থাকবে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ।

এই ব্যবস্থা সত্যি সত্যি যদি বাস্তবায়ন হয়, তা হলে হয়তো আশির দশকের ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার গানটি নতুন রূপে ফেরত আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে; সম্ভাবনা রয়েছে অকার্যকর কর্মক্ষমতাকে কার্যকর কর্মক্ষমতায় রূপান্তর করার। হয়তো সেদিনই আমরাও রাজধানীর সরদঘাট থেকে উত্তরা যাব মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। প্রবাদ আছে- আশায় ফুল ফোটে সম্ভাবনার। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

এমটিআই