পাবনা: গার্মেন্টেস এর ফেলে দেয়া কাপড় অর্থাৎ ঝুট কাপড় দিয়ে ভাগ্য বদলেছে পাবনার অনেক মানুষের। ঝুট কারখানা করে গেঞ্জি সহ বিভিন্ন বস্ত্র তৈরী ও বিক্রি করে স্বচ্ছলতা এনেছেন অনেকে। শুধু দেশ নয়, বিভিন্ন দেশে রপ্তানীও হচ্ছে এসব পণ্য। কারখানা মালিকসহ এলাকার অনেক দরিদ্র মানুষের জীবনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে ঝুট তথা হোসিয়ারি শিল্পের।
এই যেমন পাবনা পৌর সদরের সাধুপাড়া মহল্লার দেলোয়ারা খাতুন (৫০)। ১৮ বছর আগে স্বামী মারা যাবার পর সংসার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। এক ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন, তার সংসারেও রয়েছে দু’টি সন্তান। পাঁচ সদস্যের সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকতো। ছেলে দিনমজুরী করে সংসার চালান খেয়ে না খেয়ে। এমন অবস্থায় দেলোয়ারা কাজ শুরু করেন ঝুট কারখানায়। সেখান থেকে মাসে আয় করেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এখন মা আর ছেলের উপার্জনে বেশ স্বচ্ছলতা এসেছে তাদের জীবনে।
শুধু দেলোয়ারা খাতুনের জীবনেই নয়, এমন গল্প ছড়িয়ে আছে আরও হাজারো হতদরিদ্র মানুষের জীবনে। যাদের অন্ধকার জীবনে আলো ফুটিয়েছে ঝুট কারখানাগুলো। অনেক বৃদ্ধ মানুষও শেষ জীবনে কারও মুখাপেক্ষি না থেকে এখান থেকে আয় করে নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছেন।
ঝুট কাপড় অর্থাৎ গার্মেন্টেসের উচ্ছিষ্ট কাপড় দিয়ে এমনই এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পাবনার হোসিয়ারি শিল্পে। ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরী হচ্ছে গেঞ্জিসহ নানা বস্ত্র। যা সুনাম কুড়িয়েছে বিদেশেও। পাবনা হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স গ্রুপের তথ্য মতে, বর্তমানে ঝুট কাপড় থেকে উৎপাদিত বস্ত্র থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আর এ শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার নারী-পুরুষের।
হোসিয়ারি ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের তৈরি পোশাক কারখানায় প্রতিদিন ফেলে দেওয়া হয় নমুনা ও কাটিংয়ের কাপড়। যা ঝুট কাপড় হিসেবে পরিচিত। সেই ঝুট কাপড় কিনে এনে উন্নতমানের গেঞ্জিসহ নানা বস্ত্র তৈরী করছেন পাবনা হোসিয়ারী ব্যবসায়ীরা।
সাধুপাড়া মহল্লার ‘মামুন হোসিয়ারি’র মালিক মামুন হোসেন জানান, ‘প্রথমে ঝুট কাপড় কিনে আনার পর প্রসেসিং ও কাটিং করা হয়। তারপর সেলাই মেশিনে তৈরী হয় গেঞ্জি সহ নানা পরিধেয় বস্ত্র। এরপর বিভিন্ন ডিজাইনের ছাপ দেয়া শেষে প্যাকেজিং করা হয়। এমনই কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে উৎপাদিত বস্ত্র চলে যাচ্ছে সারাদেশে। সুনাম কুড়িয়ে রপ্তানী হচ্ছে বিদেশেও।’
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য মতে, গত এক দশকে পাবনা সদর উপজেলার আশপাশে বিভিন্ন গ্রামে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন ঝুট কাপড় থেকে গেঞ্জি তৈরির ৫৪২টি হোসিয়ারি কারখানা। প্রতিবছর এসব কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ কোটি পিস গেঞ্জি। যার বাজারমূল্য এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা।
এস এ হোসিয়ারীর স্বত্ত্বাধিকারী আলাল উদ্দিন প্রামানিক বলেন, ‘আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। আমার কারখানায় ৭০ থেকে ৭৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। খরচ বাদে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ থাকে। বলা যায়, ঝুট কাপড়ই আমাদের হোসিয়ারি শিল্পের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। অনেক ব্যবসায়ীর ভাগ্য ফিরেছে এই ব্যবসায়।’
রাসেল গার্মেন্টস এর মালিক আলহাজ আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আগে গার্মেন্টস চাকুরী করতাম। ১০ বছর আগে সেই চাকুরী ছেড়ে ২/৩ টা সেলাই মেশিন নিয়ে এসে নিজের এলাকায় এসে কাজ শুরু করি। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন আমার কারখানায় একশ’ মেশিন চলে, দুইশ’ শ্রমিক কাজ করেন। এখানকার তৈরি পোশাক দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছি। সরকার থেকে সুদ মুক্ত ঋণ পেলে এ খাতে আমরা আরো মানুষের কর্মসংস্থান করে দিতে পারবো।’
রুমী খাতুন, সাথী খাতুন নামের দুই শ্রমিক বলেন, ‘অনেক বেকার যুবক ও গ্রামের দরিদ্র অসহায় নারীরা কারখানায় কাজ করে মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। এতে অনেকের সংসারের অভাব চলে গেছে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে আছে। ঝুট কারখানাগুলো আমাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।’
ষাটোর্ধ চাঁদ আলী ও মন্টু প্রামানিক নামের দুই প্রবীণ শ্রমিক বলেন, ‘আমরা এই বয়সে সংসারের বোঝা হয়ে যাই। ছেলে সন্তান অনেকেই ভরণ পোষণ দিতে চায় না। কিন্তু এই জুট কারখানা আমাদের কষ্ট দূর করেছে। আমরা এখন নিজেদের খরচ নিজেরাই চালাই। কারো দিতে তাকিয়ে থাকতে হয় না।’
পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল আলম স্বপন চৌধুরী বলেন, ‘বিগত করোনা মহামারি ও ইউক্রেন সহ বহির্বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতি পাবনার হোসিয়ারি শিল্পকে ধাক্কা দিয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে আবার প্রাণ ফিরেছে। এ শিল্পের প্রসারে ও বস্ত্র রপ্তানীতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।’
পাবনা হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স গ্রুপের সাবেক সভাপতি মনির হোসেন পপি বলেন, ‘ভারত, মালয়েশিয়ায় আমাদের গেঞ্জিসহ অন্যান্য বস্ত্র রপ্তানী হচ্ছে। আমরা আরও অনেক দেশে রপ্তানী করতে চাই। এজন্য দরকার আর্থিক সহযোগিতা। কারণ আমাদের পুঁজি অল্প। সুদমুক্ত ঋণ পেলে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবেন পাবনার ব্যবসায়ীরা।’
এসএস