চট্টগ্রাম : দেশের অভ্যন্তরে বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তির চেয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের পাশ দিয়ে যাওয়া প্লেট বাউন্ডারি ও ফল্ট লাইনের কারণে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মিয়ানমারে উৎপত্তি হওয়া ৫ দশমিক ১ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্পে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়েছিল। এর আগে একই এলাকায় গত ৩ জানুয়ারির ভূমিকম্পেও কম্পন অনুভূত হয়েছিল দেশজুড়ে। আবার এই এলাকায় শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে বলে শঙ্কাও করছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্প নিয়ে শঙ্কার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আনসারী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার সীমান্তে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। খুব কাছাকাছি সময়ে আমরা ঢাকায় বসে কয়েকটি ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। ভাগ্য ভালো যে এগুলো মাটির বেশি গভীরে হয়নি। মাটির যতো গভীরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হবে ততোই আমাদের ভাবনা বাড়বে।’
[242499]
মাটির গভীরতার সাথে কি সম্পর্ক রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাটির বেশি গভীরে ভূমিকম্পটি উৎপত্তি হলে এর কম্পন অনুভূব অনেক দূর পর্যন্ত যায়। গত জানুয়ারি মাটির ১৫৯ কিলোমিটার নিচে ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে ৫ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ায় ঢাকায় বসে অনুভবের মাত্রা বেশি ছিল। অপরদিকে গতকাল মাটির ১২৬ কিলোমিটার গভীরে ঢাকা থেকে ৪৮৯ কিলোমিটার দূরে ৫ দশমিক ১ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ায় তুলনামূলকভাবে কম অনুভব ছিল।
মিয়ানমার সীমান্তে ভূমিকম্প হলেই ঢাকা পর্যন্ত কম্পন অনুভব হয় উল্লেখ করে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন,‘মিয়ানমারের উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর দিক সম্ভবত বাংলাদেশের দিকে। সেখানে ৪ দশমিক ৮ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হলেও আমাদের এখানে অনুভব হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের পাশ দিয়ে প্লেট বাউন্ডারি ও ফল্ট লাইন গিয়েছে। আর ভূমিকম্প স্বাভাবিকবাবেই বাউন্ডারি লাইন বা এর থেকে ১০-২০ কিলোমিটার দূরে হয়ে থাকে। এ কারণে ওসব এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে আমাদের জন্য শঙ্কা বাড়বে।’
[242498]
বড় ভূমিকম্প কি আসন্ন?
ছোটো ছোটো ভূমিকম্প কখনো আর্শীবাদ হয়, আবারো কখনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হয়। ভূমিকম্প গবেষণায় উভয় যুক্তি সত্যি। কখনো একটি ঘটে, আবার কখনো আরেকটি ঘটে। ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে) গত ১০ বছরে বিভিন্ন মাত্রার ৫ হাজার ২৩৬টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে। এরমধ্যে ৫ রিকটার স্কেলের উপরে ছিল ৮৪টি এবং ৬ রিকটার স্কেলের উপরে ছিল ৩টি। চলতি মাসেই দুটি ভূমিকম্প হয়েছে ৫ ও ৫.১ রিকটার স্কেলের। এছাড়া গত ৭ দিনে একই এলাকায় ৩৬টি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে।
তাহলে কি শক্তিশালী ভূমিকম্প আসন্ন? এই প্রশ্নের উত্তরে ড.মেহেদী আনসারী বলেন, ‘ছোটো ছোটো ভূমিকম্প কখনো কখনো মাটির অভ্যন্তরে সৃষ্ট হওয়া শক্তিগুলোকে বের করে দেয়, আর এতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার জন্য শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর একারণে শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে ২০০ বা ২৫০ বছর সময় নিয়ে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ১৭৬২ সালে কক্সবাজারের নিচে এবং ১৮৫৭ সালে আসামের দিকে দুটো শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই হিসেবে গণনা করলে এখন এই অঞ্চলে একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে।
ভূমিকম্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স এন্ড রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যদি একই দিনে একের পর এক কিংবা দুই বা তিন দিন ধরে টানা ভূমিকম্প হতে থাকে তখন একটি বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৪ সালের ভূমিকম্প কিংবা ২০১৫ সালের নেপালের ভূমিকম্পের সময়ে আমরা এমনটি দেখেছিলাম। একটি বড় ভূমিকম্পের আগে ও পরে অনেকগুলো ছোটো বা মাঝারি ভূমিকম্প হয়েছিল। কিন্তু ২০-২৫ দিন পর পর ছোটো ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প মাটির ভেতর থেকে শক্তি বের করে দেয়ার বিষয়টি বেশি লক্ষ্যনীয়।’
[242496]
তাহলে কি ভারত মিয়ানমার সীমান্তে বড় ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই শঙ্কা আছে। কিন্তু তা কখন হবে এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে কয়েকশত বছর পর পর বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকে। আর ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত হলো ভূমিকম্পের সবচেয়ে সক্রিয় জায়গা। এই জায়গায় প্রতিদিন ভূমিকম্প হচ্ছে। ৪ রিকটার স্কেলের বেশি হলে অনুভব হয় কিন্তু এর কম মাত্রারগুলো অনুভব হয় না।
ক্ষতি মোকাবেলায় আমরা কি প্রস্তুত?
ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে ৭ রিকটার স্কেলের একটি ভূমিকম্প হলে অবশ্যই ঢাকা চট্টগ্রামের অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে জানান ড. মেহেদী আনসারী। তিনি বলেন,‘প্রধান এই দুই শহরে ভবনের সংখ্যা যেমন বেশি তাই ঝুঁকিও বেশি। ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
একই মন্তব্য করেন ড. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প মোকাবেলায় অবশ্যই আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। ভূমিকম্প হবেই, তা বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু হবার পর কত দ্রæত দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় সেই প্রস্তুতি আমাদের থাকতে হবে।’
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সরকারের পক্ষ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে অনেকে তা মেনে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। যার ফলে গতকালের শক্তিশালী ভূমিকম্পেও তেমন ক্ষয়-ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। এই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে কাজ চলছে।
এছাড়া দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, রংপুর ও টাঙ্গাইলে ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। একইসাথে ২৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে ইকুইপমেন্ট কিনতে। এর পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে যেসব ইকুইপমেন্ট রয়েছে এর একটি জাতীয় তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। পরবর্তীতে যেখানে ইকুইপমেন্ট লাগবে সেই তালিকা অনুযায়ী সেই সংস্থা থেকে ইকুইপমেন্ট ঘটনাস্থলে পৌঁছানো হবে।
সার বিশ্বে প্রতিবছর দুই হাজার বার ভূমিকম্প হয়। এদের মধ্যে বছরে ১০০ ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে। ছোটো-বড় ২৭টি প্লেট নিয়ে গঠিত পৃথিবী প্রতিনিয়ত গতিতে থাকার কারণে প্লেটগুলোর প্রান্তসীমায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণেই টেকনাফ থেকে হিমালয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত গঠিত হয়েছিল হিমালয় পর্বতমালা।
এমটিআই