ঢাকা : সংবাদ সম্মেলন কক্ষে এসেই কেঁদে ফেললেন লিওনেল মেসি। জেরার্ড পিকে, জর্ডি আলবাসহ বার্সার অনেক খেলোয়াড়ই সংবাদ সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত। স্ত্রী ও তিন সন্তানের সামনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না মেসি, অঝোরে কেঁদেই গেছেন। কথা বলার সময় কণ্ঠ ধরে আসছিল ৩৪ বছর বয়সী আর্জেন্টিনা অধিনায়কের। কেনই বা আসাবে না। শৈশবকাল থেকে ২১ বছরের স্মৃতির গালিচা ছেড়ে তাকে যে পরিবারসহ চলে যেতে হবে নতুন ঠিকানায়।
এমন কঠিন মুহূর্ত মেসির জীবনে আগে কখনো আসেনি জানিয়ে কান্না থামিয়ে বলতে লাগলেন ফুটবল জাদুকর, গত কয়েকদিনে অনেক ভেবেছি কী বলব এখানে। সত্যিটা হচ্ছে কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। জীবনের এতগুলো বছর এখানে কাটানোর পর আমার জন্য দিনটা অনেক বেশি কঠিন। গত বছর বুরোফ্যাক্স নিয়ে নাটকের সময় (ক্লাব ছাড়তে হলে) আমি কী বলব সেটা ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু এ বছর সবকিছু অনেক ভিন্ন। এটা আমার ঘর, আমাদের ঘর। আমি এখানে থাকতে চেয়েছিলাম। সেটাই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আজ সবকিছু ছেড়ে যেতে হচ্ছে। ১৩ বছর বয়সে এখানে এসেছিলাম আমি। আজ ২১ বছর পর ক্লাবটা ছেড়ে যাচ্ছি। আমি, আমার স্ত্রী, আমার তিন কাতালান-আর্জেন্টাইন সন্তান...। ক্লাবটাতে যা করেছি, তা নিয়ে আমি গর্বিত।
করোনা পরিস্থিতির কারণে দর্শকদের সামনে থেকে বদায় নিতে না পারাটা মেসি কিছুতেই মানতে পারছেন না মেসি। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দেড় বছর ধরে মাঠে আমাদের সমর্থকদের দেখতে পাইনি। তাঁদের না দেখে বিদায় নিতে হচ্ছে, এই ব্যাপারটাই বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তবে আমি এখানে আবার ফিরব, এটা আমার ঘর। আমার সন্তানদেরও আমি কথা দিয়েছি, আমি আবার এখানে ফিরে আসব।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেসি বলেছেন, 'এভাবে বিদায় নিতে হবে কখনো ভাবিনি। মনে হয় না কেউই ভেবেছে। চেয়েছিলাম মাঠভর্তি দর্শকের শেষ একবারের অভ্যর্থনার মধ্যে বিদায় নিতে।'
মেসির বক্তব্য শেষে শুরু হত প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরুর আগে সবাই তাকে করতালিতে অভিবাদন জানান। এ সময় আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন এলএম টেন।
সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আবেগি মেসি বিস্তারিতভাবেই দিয়েছেন। বার্সায় সেরা মুহূর্ত কোনটি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এত মুহূর্তের মধ্যে কোনো একটি বেছে নেয়া কঠিন। কত শত দারুণ মুহূর্ত কেটেছে, কিছু কঠিন মুহূর্তও ছিল। তবে একটি বেছে নিতে হলে আমি বলব, আমার অভিষেক। সেখান থেকেই সবকিছুর শুরু, আমার প্রথম স্বপ্ন পূরণ।
চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে তার ভাষ্য, আমি ভেবেছিলাম সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেছে, সব বিষয়ে সম্মতি হয়ে গেছে। এরপর একেবারে শেষ মুহূর্তে জানা গেল লা লিগার নিয়মের কারণে চুক্তি নবায়নকে আনুষ্ঠানিক করা সম্ভব হচ্ছে না। এটাই হয়েছে। ক্লাবের ভেতরে কী হয়েছে আমি বলতে পারছি না। লাপোর্তা বলেছেন, চুক্তি নবায়ন হয়নি লা লিগার নিয়মের কারণে।
আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি, আমি এখানে থাকার জন্য যা কিছু করা সম্ভব সব করেছি। থাকতে চেয়েছি আমি। গত বছর চাইনি, সেটা বলেছিও। এ বছর আমি থাকতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি এই ক্লাবটা, এই জায়গাটা ছেড়ে যাচ্ছি। আমার জীবন পুরো বদলে যাচ্ছি। এখন আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। বড় বদল এটা, আমার পরিবারের জন্যও এই শহর ছেড়ে যাওয়া কঠিন হবে। তবে আমরা ঠিকঠাকই থাকব।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের সময়ে লাপোর্তার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে গিয়েছিলাম, সেখানেই নিশ্চিত ছিলাম আমি এখানেই থাকছি। এ নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। এরপর যা হয়েছে তা তো দেখেছেনই, এটা (চুক্তি নবায়ন) সম্ভব হয়নি।
কঠিন চ্যালেঞ্জ এটা, তবে এটা মেনে নিতেই হবে, নতুন করে শুরু করতে হবে। ক্লাবটা ছাড়তে হচ্ছে, এটাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ক্লাবটাকে আমি ভালোবাসি। এমন একটা মুহূর্ত আসবে, এটা আমি কখনো ভাবিনি। মিথ্যা বলছি না, সব সময়ই মনে যা আছে সেটা বলার চেষ্টা করেছি, সত্যিটা বলার চেষ্টা করেছি।
গত বছর আমি ক্লাব ছাড়তে চেয়েছিলাম, এই বছর তা নয়। এ কারণেই কষ্টটা বেশি হচ্ছে। সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে আমি এখানেই থাকব, সবকিছু ঠিক হয়ে ছিল। সমর্থকদের সঙ্গে সব ব্যাপারে আমরা সব সময়ই সৎ থেকেছি, অন্তত আমার দিক থেকে আমি থেকেছি। আমি কখনোই ক্লাবের সমর্থকদের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করিনি।
পিএসজিতে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মেসি বলেন, এটা একটি সম্ভাবনা। তবে সত্যি বলতে আজ পর্যন্ত কারও সঙ্গেই কিছু চূড়ান্ত হয়নি। (বার্সার পক্ষ থেকে মেসির চুক্তি নবায়ন না হওয়ার) বিবৃতি যখন এসেছে, এরপর থেকে অনেক ফোন এসেছে, অনেক ক্লাবই আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। আমরা এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে দিয়ে মেসি বলেন, কোপা আমেরিকার সময়েই ঠিক করেছিলাম (ছুটির মধ্যে ইবিজাতে) ডি মারিয়া ও পারেদেসের সঙ্গে দেখা করব। নেইমার তখন ফোন করল, সবার তাই একসঙ্গে দেখা হলো। ভেরাত্তিও ছিল। এটা শুধু একটা ছবিই। ওরা মজা করছিল, বলছিল, আমার উচিত পিএসজিতে যাওয়া। তবে এটা শুধু একটা ছবিই। এখানে আলাদা কিছু নেই, এর পেছনে কোনো গল্প নেই, বিস্ময়ের কিছু নেই। নিছকই ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা।
বিদায় লগ্নে মেসি নিজের চাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, বিনয়ী থেকে, সবাইকে সম্মান দেখিয়েই এই ক্লাবে বেড়ে উঠেছি আমি, চাইব মানুষ আমাকে সেভাবেই মনে রাখুক। পাশাপাশি মাঠে যা করেছি সেটাও মনে রাখুক। আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত এটা, কোনো সন্দেহ নেই। ক্যারিয়ারে অনেক অনেক কঠিন মূহূর্ত এসেছে, অনেক হার সয়েছি, কিন্তু ওসবের পর অনুশীলনে ফেরার, জবাব দেওয়ার সুযোগ থাকে। এখানে (এই কঠিন মুহূর্তের) তো পাল্টা জবাব দেয়ার কিছু নেই। এই ক্লাবে আমার সময় শেষ। অবশ্যই এটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত।
লা লিগার নিয়মের কারনের কথা নিজের মুখে মেসি নিজেও স্বীকার করে বলেন, আমি শুধু জানি লা লিগার কারণে এটা (মেসির বার্সায় থাকা) সম্ভব হয়নি, ক্লাবের দেনার কারণে সম্ভব হয়নি। ক্লাবের পক্ষে দেনা আর বাড়ানো সম্ভব নয়। তেবাসের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছেই মাত্র কয়েকবার। প্রতিবারই আলোচনাগুলো বন্ধুত্বপূর্ণই ছিল। তেবাসের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ নেই।
আবেগের মাঝেও সবাইকে বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মেসির উক্তি, বার্সা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্লাব, দারুণ একটা ক্লাব। খেলোয়াড় আসবে-যাবে। লাপোর্তা যা বলেছেন, যে কারও চেয়েই ক্লাব বড় - এটা সত্যি। সমর্থকেরা এটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, সব সময়ই এমনটা হয়েছে। ক্লাবে অনেক দারুণ খেলোয়াড় আছে, সবকিছুই শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবেই চলবে।
আবেগপ্রবণ মেসি বলেন, সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর গত কয়েকদিন খুব বেদনার ছিল। এখন যখন আমি বাড়ি ফিরব, সবকিছু আরও খারাপ লাগবে। তবে এই মুহূর্তটাতে আমার পরিবারের আরও কাছে থাকা দরকার, যাঁদের ভালোবাসি তাদের সঙ্গ দরকার। ফুটবল খেলে যাওয়া দরকার, যে কাজটা আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। একবার ফুটবল খেলতে শুরু করলে সবকিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সোনালীনিউজ/এআর/এমটিআই