ঢাকা: ভুলে ভরা এক বিশ্বকাপ গেল বাংলাদেশের। মাঠের বাইরের ভুলগুলো তবু কাটিয়ে ওঠা যেত যদি মাঠে ভুল কম হতো। কিন্তু মাঠেও যে ঘটে গেছে একটার পর একটা ভুলেরই প্রদর্শনী! ডানহাতির বিপক্ষে বাঁহাতি এবং বাঁহাতির বিপক্ষে ডানহাতি না খেলানোর অদ্ভুত এক নিয়ম মেনে চলে বাংলাদেশ দল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে তাই ভালো বল করেও ওভারের কোটা পূরণ করতে পারেননি সাকিব আল হাসান।
প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ, বিশেষ করে টপ অর্ডারে যে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের ছড়াছড়ি! আবার সেই যুক্তিতেই আগের ম্যাচগুলোতে ভালো বল করা তাসকিন আহমেদকে সেদিন খেলানো উচিত ছিল। সেটা না করে বাংলাদেশ মাঠে নামে বাড়তি বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদকে নিয়ে। সাকিবের মতো তিনিও সে ম্যাচে সব ওভার করার সুযোগ পাননি। এর তো একটাই অর্থ দাঁড়ায়-পরিকল্পনায়ই গলদ থেকে গেছে বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচটার দিকেও তাকান।
ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মূল ব্যাটসম্যানদের সবাই ডানহাতি। অথচ সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতির পরও একাদশে রাখা হয়নি বাঁহাতি স্পিনার নাসুমকে। ব্যাটিংটা যে রকম নিকৃষ্ট পর্যায়ের হয়েছে, তাতে দুবাইয়ে সেদিন বিশ্বসেরা বোলার এনেও হয়তো অস্ট্রেলিয়ার জয় ঠেকানো যেত না, কিন্তু চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনায় অগোছালো ছাপটা তো থেকেই গেল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের পর সেটা স্বীকার করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক ক্রিকেটারও, ‘আমাদের পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতিতে ভুল ছিল। তবে এ জন্য একা কাউকে দায়ী করা যাবে না। এটা আমাদের সবার ভুল।’
টি-টোয়েন্টি খেলার মানসিকতা না থাকার সঙ্গে কিছু নিয়মিত ভুল আর দুর্ভাগ্যকে সঙ্গী করেই হতাশার রাস্তায় হেঁটেছে লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা।
ভুল, অসামর্থ্য ও দুর্ভাগ্য
সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেশে ফেরার আগে কিছুটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফেরার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ দলের; কিন্তু সাকিব আল হাসানের শেষ দুই ম্যাচে না থাকাটা বড় ক্ষতিকর ছিল দলের জন্য। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বে টানা চার ম্যাচ হেরে সেমিফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের। বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ৩ রানে হেরে একেবারে তীরে গিয়ে তরী ডুবে টাইগারদের। এর আগে বাংলাদেশের ভুলের সূত্রপাত হয় প্রস্তুতি ম্যাচ থেকেই। শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারার পর সতর্ক হওয়ার সুযোগ থাকলেও, এই হারকে পাত্তাই দেয়নি বাংলাদেশ। সেখান থেকে কোনো শিক্ষাও নিলেন না রাসেল ডোমিঙ্গোর শিষ্যরা। মাঠের ক্রিকেটে ব্যর্থতার পাশাপাশি মাঠের বাইরেও ভালো নেই বাংলাদেশের ক্রিকেট। কথার লড়াই, মান-অভিমানের ছড়াছড়িতে কখনো বোর্ড কর্মকর্তা, কখনো আবার সরব দেখা যায় ক্রিকেটারদের।
সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন এ বিষয়ে বলেন, একটা জবাবদিহিতার জায়গা তো ক্রিকেটারদের থাকা উচিত, তাই না। কারণ ওরা তো বোর্ডের বেতনভুক্ত। চাকরিতে কেউ ভুল করলে এর জবাবদিহিতা চাওয়া হয়, সেখানে ক্রিকেটাররা তো বাইরের কেউ নয়’।
অথচ সুজনের পাশাপাশি সাকিব আল হাসানও প্রত্যাশা করেছিলেন, বাংলাদেশ এবার সেমিফাইনালে খেলবে। ওমানের মাসকটে স্কটল্যান্ডের কাছে হারের পর স্বাগতিক ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে জয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর পর সাহস বেড়ে গিয়েছিল টাইগারদের। এরপর শ্রীলঙ্কার কাছে ভুল, ইংল্যান্ডের কাছে সামর্থ্য ও ভাগ্য সহায় না থাকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হারতে হয়েছে টি-টোয়েন্টি খেলার মানসিকতা না থাকার কারণে। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে হারের পর মানসিকভাবে বিষণ্ণ ছিলেন ক্রিকেটাররা। সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটা দেওয়ার পরেও ম্যাচের শেষ বলে এসে হারতে হয়েছে। ব্যাটিং ও বোলিং এ ব্যর্থতার পাশাপাশি ক্যাচ মিস এখন অসুখের মতো বাংলাদেশ দলে। এখন পর্যন্ত ৯টি ক্যাচ ছেড়েছেন এই আসরে টাইগাররা।
মাহমুদউল্লাহর জবাব ও মুশফিকের আয়না–তত্ত্ব
ক্রিকেট বোর্ডের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা সমালোচনা ভীষণ চাপ হয়ে বসেছিল দলের জন্য। পরে সেই চাপটা তাঁরাই আবার নিজেদের ওপর দ্বিগুণ করে নিলেন অসময়ে সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে। পরের ম্যাচে ওমানের মতো দুর্বল প্রতিপক্ষকে হারিয়েই সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহ কথার চাবুক চালালেন।
পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে সমালোচকদের আয়নায় মুখ দেখার পরামর্শ দিলেন মুশফিকুর রহিম। বিশ্বকাপ তো নয়, যেন একটা গৃহযুদ্ধ! কথার ছিপি খুলে দিয়ে ক্রিকেটাররা যদি পারতেন পরের ম্যাচগুলোতেও পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে, তাহলে একটা কথা ছিল।
কিন্তু সেটা তো তারা পারেননি। টুর্নামেন্টের মাঝপথে এসব বলে উল্টো খেলা থেকেই মনোযোগটা হারিয়ে ফেললেন সবাই। নিজেরাই চাপ নিয়ে এলেন নিজেদের ওপর। এ নিয়ে পরে দলের এক ক্রিকেটারের কথা, ‘এই বিশ্বকাপে আমাদের সবই ভুল ছিল। এটাও (সমালোচনার জবাব দেওয়া) তার মধ্যে একটা।’
সাফল্যের পথে অন্তরায় নিম্নমানের উইকেট
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে একেক সময় একেক ধরনের উইকেট তৈরি করা হয়। যে কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে গেলেই বাধে বিপত্তি। বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে পর পর দুই সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ভক্তকুলের প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে উঠেছিল; কিন্তু বিশ্ব মঞ্চে গিয়ে মুদ্রার উল্টো পিঠটা দেখল খুব অল্প সময়ের মধ্যে।
সুপার টুয়েলভে টানা চার ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যাটারদের ব্যর্থতাই নজরে এসেছে দলের সঙ্গে থাকা নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনের। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে স্লো-লো উইকেট বানিয়ে সাফল্য পেলেও, তার মতে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে ভালো করার জন্য ঘরের মাঠে ভালো উইকেট বানানোর কোনো বিকল্প নেই। যেখানে নির্দ্বিধায় সাহসী আর বড় শট খেলার সাহস গড়ে আত্মবিশ্বাসটাও বাড়ত।
মাশরাফির অন্যরকম তাগিদ
বিশ্বকাপে ব্যর্থতায় খেলোয়াড়দের সঙ্গে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরাও জড়িয়ে গেছেন। এই যেমন সাকিব আল হাসানের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির মাশরাফি ও তামিমের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ২০১৯ বিশ্বকাপে কেন বাংলাদেশ দল ব্যর্থ হয়েছিল। দল ও খেলোয়াড়দের নিয়ে সমালোচনা একেবারে সহ্য করতে পারেন না মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ-মুশফিকুর রহীমরা।
সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা তৈরির পাশাপাশি মাঠে ভালো করতে কিছু পরামর্শ দিয়ে সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেন, ‘সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা মাঠে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার চেয়ে কম নয়। ফিল্ডিংয়ে ভালো করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়তে হবে। কোনো ম্যাচে ব্যাটিং ভালো হচ্ছে আবার কোনো ম্যাচে ভালো হচ্ছে বোলিং। ক্যাচ মিসকে খেলার অংশ হিসেবে মানতে হবে; কিন্তু এর জন্য যদি আমরা নিয়মিত ম্যাচ হারা শুরু করি, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। অনুশীলনে কিন্তু সবাই অনেক বেশি পরিশ্রম করে থাকে।’
ফিল্ডিং কোচ না ক্রিকেটার, দায় কার?
ফিল্ডিং কোচ হিসেবে রায়ান কুককে যেন আর রাখতে পারছে না বাংলাদেশ। নিয়মিত ক্যাচ মিস যেন ম্যাচ মিসে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের জন্য। সে কারণে এখন এতে কার দায় সেটি খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশ্বকাপের ছয় ম্যাচে ১২টি ক্যাচ মিসই প্রমাণ করে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বড় মঞ্চে খেলতে গেলেই নিজেদের ঠিকঠাক মেলে ধরতে পারেন না বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে খারাপ ফলাফলের পেছনে বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডারদের ব্যর্থতা ছিল স্পষ্ট। দুই বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ক্যাচ মিসে ম্যাচ হাতছাড়া হওয়ায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন কার্যত শেষ হয়ে গেছে।
কোচদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই
মাসিক ১০ লাখ টাকা বেতনে ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুককে রাখা হয়েছে; কিন্তু ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ কতটা উন্নতি করেছে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। বিশেষ করে ফিল্ডাররা যখন একটার পর একটা ক্যাচ ছাড়ছেন। আর হেড কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো বাংলাদেশে এসেছিলেন হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ইউনিটের কোচ হতে। কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলার অভিজ্ঞতা থাকা এই কোচ এখন হন্তারক হয়ে গেছেন। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি ক্রিকেট বোর্ডও তার কর্মকাণ্ডে নাখোশ হয়েছে।
অথচ ২০১৪ সালে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকার সময় কোচ হিসেবে চন্দ্রিকা হাতুরুসিংহকে কোচ করার পর দারুণ পরিবর্তন আসে দলে। এই লঙ্কান অধিনায়ক বানান মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। এরপরই ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়াটার ফাইনালে খেলে লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা; যা এখন পর্যন্ত বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। অথচ রাসেল ডোমিঙ্গো আসার পর যেন সবকিছুই পাল্টে গেছে। মাঠের চেয়ে বাইরের ক্রিকেটই বেশি আলোচনায় থাকছে। ডোমিঙ্গোকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেটে বেশ পরিণত আর সমীহ করার মতো দল। টেস্টে কোনো মতে চললেও টি-টোয়েন্টিতে সব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কোচ মাঠে গিয়ে খেলে দিয়ে আসেন না। তবে খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করার পাশাপাশি পারফরম্যান্সের গ্রাফটাকে উপরের দিকে তুলে ধরতে সহায়তা করে থাকেন। জাতীয় দলের ক্রিকেটার যারা তারা সবাই বিশ্বমানের এটা জেনে তবেই চাকরি নিয়ে থাকেন কোচরা। একজন কোচ ক্রিকেটারদের যাচাই করার পাশাপাশি দেখেন ও বোঝেন কার কোথায় সমস্যা। একজন ক্রিকেটার নির্দিষ্ট বয়সের পর আর টেকনিক বদল করতে পারেন না বলেই তাকে ওই জায়গা থেকে উন্নতি করতে হয়। টেকনিক বদলাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই জিতলে যদি কোচের কৃতিত্ব থাকে, তাহলে হারলেও সেটি নিতে হবে একজন কোচকে।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দায় স্বীকার
নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারছে না বলেই বাংলাদেশ দল এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রত্যাশিত ফল পায়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সুপার টুয়েলভের ম্যাচটি বাংলাদেশ দেশের বাইরের কোনো ভেন্যুতে খেলছে বলে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি। খুব কাছে গিয়েও জিততে না পারার কষ্টটা যেন শেষই হচ্ছে না।
তাই পরাজয়ে নিজেদের দায় স্বীকার করে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বলেন, ‘খুব কাছে গিয়েও জিততে না পারায় খারাপ লাগছে। আমরা দর্শকদের হতাশ করেছি। প্রবাসী দর্শকরা সব কটি ম্যাচেই আমাদের সমর্থন দিচ্ছে। দয়া করে আমাদের সমর্থন করতে থাকুন। আশা করি, আমরা জয় উপহার দিতে পারব বলেই আশা রাখি।’ ফিল্ডিংয়ের কারণে কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়াকেই পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে অবহিত করে রিয়াদ বলেন, ‘বোলাররা ভালো বল করলেও ফিল্ডাররা নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। এই পরাজয় ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হিসেবে মনে করতে হবে। দল হিসেবে খেলতে পারলে ভবিষ্যতে আরও সুযোগ থাকবে বাংলাদেশ দলের জন্য।’
সোনালীনিউজ/এআর