ঢাকা: সাত বছর পর ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় ব্রাজিল। শেষবার থ্রি লায়ন্সের বিপক্ষে যে মাঠে গোলশূণ্য ড্র করেছিলো সেলেসাও।
সেই ওয়েম্বলিতে আবারও নামার অপেক্ষায় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। শনিবার (২৩ মার্চ) বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত একটায় প্রীতি ম্যাচটিতে মুখোমুখি হবে দল দুইটি।
বিশ্বকাপ থেকেই যেন অন্য এক ব্রাজিলকেই দেখছে ফুটবল বিশ্ব। তিতে চলে গেলেন ঘোষণা অনুযায়ী। এরপর, ব্রাজিলের দুঃস্বপ্নময় পথচলা দীর্ঘায়িত হলো আরও!
আগেভাগে তিতের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনকে (সিবিএফ) অবশ্য কিছুটা সুবিধা করে দিয়েছিল। নতুন কোচের সন্ধানে প্রচুর সময় পেয়েছিল সংস্থাটি।
কিন্তু নানা কারণে এত সময়ও যথেষ্ট হলো না। ফলে, দুঃসময়ের ঘোরপাক থেকে বেরিয়ে আসা হয়নি বিশ্বকাপের রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের। বরং সময় যত গড়িয়েছে, ততই যেন আরও ফিকে হয়েছে তারা। যারাই এসেছেন, শক্ত হাতে হাল ধরতে পারেননি কেউ।
তিতে-পরবর্তী সময়ে সেলেসাওরা চলেছে দুই অন্তর্বর্তীকালীন কোচের হাত ধরে-রামোন মেনেজেস ও ফের্নান্দো জিনিস। আরও একজন কোচের নাম ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়েছে সিবিএফের কর্মকর্তাদের মুখে, বারবার। প্রকাশ্যে তারা এ নিয়ে বুলিও আউড়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়নি- নামটি হচ্ছে কার্লো আনচেলত্তি।
আনচেলত্তি ‘না’ বলে দেওয়ার পর সিবিএফকে নিতে হয় নতুন সিদ্ধান্ত। দরিভাল জুনিয়রের কাঁধে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব তুলে দেয় তারা। শনিবার ঐতিহ্যবাহী ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিল যখন খেলতে নামবে, সেলেসাওদের ডাগআউটে থাকবেন দরিভাল। নতুন আশায় শুরু হবে তাদের নতুন পথচলা। তবে ‘একটি ব্যর্থতায় ভরা বছর’ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনার ইতি কি ঘটবে?
কেন বিষয়গুলো এমন লেজেগোবরে হয়ে গেল, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো ঝুলে থাকল দিনের পর দিন, তা নিয়ে বিবিসি স্পোর্টকে নিজের ভাবনা জানিয়েছেন ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার ওয়াল্তার কাসাগ্রান্দে।
“ভীষণ অগোছালো এবং দলটা ব্রাজিল বলেই যে কোনো কোচ দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ডাকলেই দৌড়ে আসবেন- এমন কিছু একগুয়ে বিশ্বাসের ফল হলো এটা (বিব্রতকর বছর)।”
[220094]
সিবিএফের অস্থিরতা ও কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের চড়া মাশুলই ব্রাজিল ফুটবলকে গুনতে হয় ২০২৩ সালে। ১৯৬৩ সালের পর প্রথমবারের মতো এক বছরে তাদের জয়ের চেয়ে হার ছিল বেশি। ৯ ম্যাচের মধ্যে পরাজয় পাঁচটিতে, জয় মাত্র তিনটিতে, একটি ড্র।
এই হতাশাময় পথচলায় বেশ কিছু অস্বস্তিকর রেকর্ডও গড়ে ব্রাজিল। এই তিন হারের মধ্যে একটি ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে, ঘরের মাঠে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ বাছাইয়ে টানা তিন ম্যাচে (কলম্বিয়া, উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে) পরাজয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয় তাদের।
গোল হজমে তারা এরই মধ্যে ছাপিয়ে যায় আগের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের পুরো সময়কে! ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইয়ে এখন পর্যন্ত খেলা ছয় ম্যাচে ৭ গোল হজম করেছে ব্রাজিল; সেখানে আগের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের পুরো মিশনেও এত গোল খেতে হয়নি তাদের; ১৭ ম্যাচে সেবার তাদের জালে প্রতিপক্ষ বল পাঠিয়েছিল স্রেফ পাঁচবার।
ব্রাজিল গত বছর কেবল গিনি, বলিভিয়া ও পেরুকে হারাতে সক্ষম হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রাজিলের আত্মবিশ্বাস যতটা নিচে নেমেছিল, এবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে আগে তা হয়তো আরও তলানিতে নেমেছে।
ওয়েম্বলির আসছে ম্যাচে সব পিছুটান এক পাশে রেখে, সাম্প্রতিক বছরের হতাশা ভুলে ব্রাজিল নতুন শুরুর আশা নিয়ে নামবে, সেই আশাও করছেন কাসাগ্রান্দে। তবে বর্তমানের এই ফুটবল পন্ডিতের কণ্ঠে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলুনি স্পষ্ট। বর্তমান দল নিয়ে যে তার কণ্ঠে উচ্চাশার স্ফুরণ নেই।
“ইউরোপের কোনো শীর্ষ দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না ব্রাজিলের বর্তমান দলটি। আমার কথাগুলো ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ক্রোয়েশিয়া ও অন্য কিছু দলের বেলায়ও খাটবে।”
বর্তমান উত্তরসূরিদের নিয়ে কাসাগ্রান্দের এমন বিরূপ মনোভাবের কারণ খুঁজতে গেলে আবারও তাকাতে হবে পেছনেই। ২০০২ সালে সবশেষ বিশ্বকাপ জয়ের পর ফুটবলের বৈশ্বিক মঞ্চে আর সাফল্যের গল্প লেখা হয়নি তাদের।
এর আগে দুই বিশ্বকাপ জয়ের মাঝে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধান ছিল ২৪ বছরের, ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪, এই সময়কালে। কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ায় ২৪ বছরের খরায় ফের পা দিয়েছে তারা।
কাতারের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্রাজিলের স্থানীয় পর্যায়ের কোচদের ‘সিভি’ দেখে মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে আরেকটু ধৈর্য্য ও সময় নিয়ে কোচ নিয়োগের বিতর্ক শুরু হয়েছিল। সে সময়ই আনচেলত্তিকে আনার কথা ওঠে।
তখনও রেয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে আনচেলত্তির চুক্তির মেয়াদ ছিল আরও এক বছরের বেশি। সিবিএফ সভাপতি এদনালদো রদ্রিগেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আনচেলত্তির জন্য অপেক্ষার। আসছে কোপা আমেরিকায় এই ইতালিয়ান কোচ দলের দায়িত্বে থাকবেন - এমন কথার তুবড়িও তিনি ছুটিয়েছিলেন, একাধিকবার।
“তিনি (আনচেলত্তি) সেখানে (কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের ডাগআউটে) থাকবেন এবং এটা নিশ্চিত।”
এই ডামাডোলের সময় ব্রাজিল জাতীয় দল ঘিরে পরিস্থিতি এতটাই এলোমেলো হয়ে পড়েছিল যে, অনূর্ধ্ব-২০ দলের কোচ মেনেজেস তখন আর্জেন্টিনায় ছিলেন বিশ্বকাপ মিশনে। টুর্নামেন্ট চলার মধ্যে ছুটির সময়ে আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিলে উড়ে এসে জাতীয় দলের প্রীতি ম্যাচের দল ঘোষণা করে ওই দিন তাকে ফিরতে হয়েছিল প্রতিবেশী দেশে। মেনেজেসকে তখন বাধ্য হয়ে এই দৌড়ঝাঁপ করতেই হয়েছিল, কেননা, ব্রাজিলের জাতীয় দল নির্বাচনের যে কেউ ছিল না!
সংক্ষিপ্ত সময়কালে মেনেজেস কর্তৃপক্ষকে তুষ্ট করতে ব্যর্থ হন। এবার সিবিএফ সভাপতি রদ্রিগেস আবারও আরেকটি ব্যতিক্রমী সমাধান নিয়ে হাজির। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে ঘোষণা দেন জিনিসের নাম এবং তখনও জিনিস কোপা লিবের্তাদোরেস চ্যাম্পিয়ন ফ্লুমিনেন্সের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন!
যদিও ঘরোয়া ফুটবলে জিনিস উঁচু মানের কোচ হিসেবে বিবেচিত, কিন্তু তিনিও ব্রাজিলের কোচ হিসেবে প্রভাব রাখতে পারলেন না। মন জয় করতে পারলেন না সমর্থকদের। হয়তো পরিস্থিতি যেন আরও জঘন্য না হয়, সে জন্য স্থানীয় আদালত গত ডিসেম্বরে রদ্রিগেসকে সিবিএফ সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ফিফার নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে পড়ে ব্রাজিল। পরিস্থিতি হয়ে যায় আরও ঘোলাটে।
পরের ধাক্কাটি আসে ওই মাসের শেষ দিকে, যখন আনচেলত্তি জানিয়ে দেন, রেয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ২০২৬ সাল পর্যন্ত চুক্তি নবায়ন করবেন তিনি।
“আমার প্রতি ব্রাজিলের আগ্রহের জন্য আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি বিষয়গুলো কিভাবে চাই, সেটা মূখ্য। এখানেই থাকছি।”
[220091]
আনচেলত্তির এই ঘোষণা ব্রাজিল ফুটবলের ইতিহাসে ‘মহা বিব্রতকর’ পরিস্থিতির একটি বলে মনে করা হয়। যদিও আরেক ব্রাজিলিয়ান গ্রেট তোস্তাও ‘ফোলহা দে সাও পাওলো’ পত্রিকার কলামে এ বিষয়ে নিজের মনোভাব জানিয়েছিলেন। সেখানে এই ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ী উল্লেখ করেন দুই পক্ষের কারো কাছ থেকে সত্যিকারের নিশ্চয়তা না পাওয়ার কথাটিও।
“আনচেলত্তি কখনোই নিশ্চিত করেননি তিনি ব্রাজিলের কোচ হবেন, কিংবা সিবিএফ কখনও আনচেলত্তি দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন, এমন অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করেনি।”
নানা ইস্যুর দোলাচলের মধ্যে ২০২৪ সাল ব্রাজিল শুরু করেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি, অন্তর্বর্তীকালীন কোচের হাত ধরে। তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নটাও হয়তো ছিল যৎসামান্য। ব্রাজিলের ফুটবলের আলোকে যা ছিল খুব, খুব নেতিবাচক বিষয়।
জানুয়ারির শুরুর দিকে অবশ্য একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। সভাপতির পদে ফেরেন রদ্রিগেস এবং দায়িত্বে ফিরেই তিনি ফোনে ফোনে ছাঁটাই করে দেন জিনিসকে; দলের হাল তুলে দিলেন দরিভাল জুনিয়রের হাতে।
পূর্বে কিছু মরিয়া দলের ত্রাতা হয়ে ওঠা দরিভাল অনেকের কাছে পরিচিত ‘ফায়ারফাইটার’ নামে। ব্যক্তিজীবনেও দারুণ সংগ্রামী ও জয়ী তিনি। ২০১৯ সালে ধরা পড়া প্রোস্টেট ক্যান্সারের বিপক্ষে লড়াইয়ে জিতেছেন।
২০২২ সালে কোপা লিবের্তাদোরেস এবং ব্রাজিলিয়ান কাপে টানা দুই মৌসুম হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি তার জন্য বিশেষ অনুভূতির বটে। কাসাগ্রান্দেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দরিভালের হাত ধরে বিবর্ণ ব্রাজিলের নতুন পথচলা দেখতে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই অপেক্ষা কেবল কাসাগ্রান্দের নয়, ব্রাজিলের সব ফুটবলপ্রেমীরও। শনিবার ওয়েম্বলির ম্যাচের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন তারাও।
এআর